খালেদ মোর্শেদ
প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি শ্রদ্ধেয় আবেদ ভাইকে। মহান আল্লাহ্ আপনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন।
দেশে বিদেশে কাজের সুবাদে আবেদ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে বহুবার কিন্তু স্মরনীয় হয়ে আছে প্রথম দেখা। সেটা ছিলো ঝিনাইদহ জেলার কালিগনজ ব্রাঞ্চে ১৯৯২ সালে, খুবই একটি ছোট মিটিং ছিলো আমরা কয়েকজন কর্মী, আবেদ ভাই, আমিন ভাই এবং অসিত দাদা। অনেক কথার মাঝে যে কথাটি বেশী জোর দিয়ে বলেছিলেন আবেদ ভাই তাছিলো- ব্র্যাক দারিদ্র বিমোচন এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করছে। ব্র্যাকের গ্রাম সংগঠন গুলো হবে ব্র্যাক হবে এক একটি ইনস্টিটিউশন, কারো অবর্তমানে এগুলো থেমে থাকবেনা।
আমরা তখন ৫০ জন নারী সদস্য নিয়ে গ্রামে গ্রামে সমিতি তৈরি করতাম। ডিপ টিউবওয়েল বসাতাম যার মালিক হতো সদস্যদের স্বামী বা গ্রামের সাধারণ মানুষ। পুকুর পুনঃখনন, রোড সাইড প্লান্টেশন, ভিজিডি কর্মসূচি সহ আরো অনেক। সদস্যদের আয় বৃদ্ধির জন্য কৃষি, মৎস, গবাদিপশু পালন, মুরগি পালন, তুঁত চাষের মাধ্যমে রেশম গুটি উৎপাদন।সদস্যদের নিয়ে সাপ্তাহিক ইস্যুভিত্তিক সভা।
নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং সঞ্চয় মনোভাব তৈরীর জন্য কথা বলতাম। স্টাফ ডেভলপমেন্ট/ মানব সম্পদ তৈরীর অংশ হিসাবে প্রচুর প্রশিক্ষণ হত। প্রশিক্ষন কেন্দ্রে ইনিস্টিটিউশন বিল্ডিং তখন একটি বহুল প্রচলিত শব্দ ।আমার প্রিয় প্রশিক্ষক শরিফ ভাই, আমান ভাই, হুমায়ূন ভাই, শফিক হাসান সাইদ ভাই, অলিউর রহমান ভাই হাবিব ভাই রফিক ভাই প্রতিটি প্রশিক্ষণেই ইন্সটিটিউশন বিল্ডিং কথাটা বেশি বেশি বলতেন।
আবেদ ভাইয়ের স্বপ্ন ছিলো ব্র্যাক এবং এর গ্রাম সংঠন সমুহ হবে এক একটি ইন্সটিটিউশন। আমাদের কে বলা হতো গ্রাম সংগঠন এবং এর সদস্যদের এমন ভাবে তৈরী এবং প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে যেন তারা নিজেরা যেন নিজেদের সংগঠন গুলোর দায়িত্ব নিতে পারে এবং ব্র্যাকের সহযোগিতা ছাড়াই নিজেরা চালাতে পারে। আবেদ ভাই-এর অনেক কথার মাঝে আজো মনে পড়ে তিনি Institution building শব্ধ টাকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন আজ আমরা সত্যিই দেখতে পাই বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ইনস্টিটিউশন। বাংলাদেশের ইন্সটিটিউশন। ব্র্যাক।
কাবুল, আফগানিস্তান, ২০০২: ব্র্যাকের প্রথম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাত্রা। সৌভাগ্য আমার ৩ জন আঞ্চলিক ব্যবস্থাপকের এর এক জন হওয়ার। কাবুলে আমি, পারওয়ান প্রভিন্সের চারিখারে রফিক এবং মাজার-ই-শরীফে এনামুল হক। আমরা ৩জনই কক্সবাজারে কাজ করেছি। আবেদ ভাইয়ের প্রথম কাবুল ভিজিট।
১. চারিখারে গ্রাম সংগঠন ভিজিট করেন। সদস্যদের পরিবার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি নিয়ে অনেক কথা বললেন দেখলেন এবং শুনলেন। গ্র্রুপ মিটিং-এ খাতায় সঞ্চয় আদায় দেখলেন। সদস্যরা কিভাবে তাদের টাকার হিসাব রাখে তা জিজ্ঞাসা করলেন। আমাদের নতুন কর্মসূচি। পাস বই ছিল না। আবেদ ভাই সেটা খেয়াল করলেন। অফিসে ফিরে তিনি শুধু বলেছিলেন তোমরা ওদের পাশবইটা দিয়ে দিও। আস্থা অর্জনের কথা বললেন, দায়বদ্ধতার কথা বললেন। সে রাতেই আমি আফগান সহকর্মী নাজিয়াকে নিয়ে দারি ও ইংরেজিতে পাশবই তৈরি করে ফেলি।
২. MISFA-তে মিটিং: দেশব্যাপি শাখা অফিস খোলা, কর্মসূচির বিস্তার, ফান্ডিং নিয়ে হাই লেভেল মিটিং। আবেদ ভাইয়ের সামনে স্টিভ ম্যাককুইন, রোজি খান জুরমতী, ক্যারোলিন পাশে আমিন ভাই, জালাল ভাই, শহিদ ভাই এবং আমি। স্টিভ ম্যাককুইন ফান্ডিং করবে কি করবে না, দেখবে, একটু সময় নিবে? ডিসাইড করবে – এমন ভাবেই কথা বলছে। আবেদ ভাইয়ের আস্থার জায়গা হচ্ছে – ফান্ডিং? কর্মসূচি? এটা কে দিবে, ব্র্যাক কত বড় হবে সেটা আমি বুঝবো!
এটি আমার জন্য এক অনন্য অনুভূতি ছিলো । তাঁর ব্যাক্তিত্ব, আস্থা – এই প্রথম দেশের বাইরে তার পাশে বসে তাঁকে দেখার সুযোগ।
৩. কর্মীদের জন্য অনুভূতি: তার সফরসঙ্গী ছিলেন মরহুম ফারুক চৌধুরী। ফারুক ভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন কি বাড়ি যাওয়ার জন্য মন খারাপ হয়? উত্তরটা আবেদ ভাই-ই দিয়েছিলেন, ওরা ৫ মাস ৯ দিন পর পরই দেশে যাবে এইতো আর কয়েকদিন। যে কয়দিন ছিলেন দুপুরে – রাতে সবার সাথে খেয়েছেন, কথা বলেছেন, দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে উদ্বোদ্ধ করেছেন।
৪. বাজেট: আমি তখন এক্সলে একেবারেই নবিস। আবেদ ভাই আমার করা বাজেট দেখতে চাইলেন। দুই একটি লাইন উপর নিচ করতে বললেন, ফর্মূলা যোগ করতে বললেন। কিছু নির্দেশনা দিলেন। সারারাত জেগে কাজ করে আবেদ ভাইকে সেই বাজেট যে সকালে দেখাতে পেরেছিলাম সে এক অনন্য অনুভূতি।
লিফ্টে দেখা অতপর মাইক্রোফাইন্যান্স ফ্লোর ভিজিট: ২০১৭ শুরুর দিকে ব্র্যাক সেন্টারের স্টাফ ক্যান্টিনের সামনে লিফ্টের জন্য আবেদন ভাই দাঁড়িয়ে আছেন সাথে কলকাতার বন্ধনের চন্দ্রশেখর দাদা। শেখর দা আমাকে বললেন কেমন আছেন? আবেদ ভাই বললেন শেখরকে চিন নাকি? শেখর দাদাই বললেন আমরা কুমিল্লায় একসাথে কাজ করেছি। আবেদ ভাই বললেন চল তোমাদের ফ্লোরে যাই আর শেখরদাকে বললেন ওরা মাইক্রোফাইন্যান্স ডিজিটাইজ করছে তুমি দেখে যেও। সত্যিই অবাক হই – আবেদ ভাই এই সাধারণ খবরও রাখতেন।
কক্সবাজারে আবেদ ভাই: ২০১৮ এর ফেব্রুয়ারি এবং ২০১৯ এর জুনে কক্সবাজারে আবেদ ভাইকে দুবার রিসিভ করার সৌভাগ্য হয়। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিদর্শন, উখিয়ায় আয়েশা আবেদ ফাইন্ডেশন এর উদ্ভোধনী অনুষ্ঠান, কক্সবাজারে সরকারি বেসরকারি ও ইউএন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং সুধী সমাবেশ, সায়মনে খাবার টেবিলে কাছে ডেকে কথা বলা, পরদিন যাবার আগে পাশে দাঁড়করিয়ে ছবি তোলা।
অন্যদিকে যখন ফিল্ডে গিয়েছেন সেখানে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সাথেই বেশি কথা বলেছেন সময় দিয়েছেন। দুটি মিটিং-এ ক্যাম্পের বাসিন্ধাদের মিটিং-এ খুবই মনোযোগ দিয়ে তাদের তাদের কথা শুনেছেন। ক্যাম্প ৮ ওয়েষ্টের ঢালু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে তিনি বনাঞ্চল ধ্বংশ হয়ে যাওয়ায় অনেক গাছ লাগাতে বলেছেন। উখিয়ায় আয়েশা আবেদ ফাইন্ডেশন ভিজিটে যে মমতায় প্রতিটি কর্ণার ভিজিট করেছেন, কর্মীদের সাথে কথা বলেছেন, ফাউন্ডেশন কর্মীদের আয় নিয়ে জানতে চেয়েছেন তা আমার স্মৃতিতে আজো জাগরুক।
Khaled Morshed
Chief Executive Officer BRAC Liberia Microfinance Company Limited
E: [email protected]
Skype: khaled_brac
M: +231777892375
Discussion about this post