ঝর্ণা মনি:
মহান একাত্তরের মার্চের উত্তাল ঢাকার রাজপথ। অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতেই ঢাকার রাজপথে সুসংগঠিত নারী ব্রিগেডের রাইফেল প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ, ধানমন্ডি, কলাবাগানে এসব প্রশিক্ষণ হতো। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী পরিচিত ছবিগুলোর একটিতে দেখা যায় প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্র হাতে মার্চপাস্ট করছেন বাংলা মায়ের আত্মপ্রত্যয়ী দামাল মেয়েরা। সশস্ত্র নারী যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শ্যামলবরণ দৃঢ়চেতা এক নারী। যেন সবুজ-শ্যামল বাংলা মায়ের প্রয়োজনে গর্জে ওঠার রণমূর্তি। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষার্থী ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা।
নেত্রকোনার হাওর, জল, মাটির গন্ধ লেগে থাকা শিশুবেলাতেই পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ রোকেয়া কবিরের মননে গেঁথে দেয় কৃষক আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, হাজং বিদ্রোহ, কমিউনিস্ট আন্দোলন। কাটলী গ্রামের সৈয়দ মোহাম্মদ খান এবং সৈয়দা বদরুন্নেসার সন্তান রোকেয়া কবিরের জন্ম ১৯৫১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। পারিবারিক আবহই ছোট থেকে সংগ্রামী জীবনে উদ্ধুদ্ধ করে। খেলাঘর এবং ছাত্র ইউনিয়ন ছিল তার আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা। ফলে ১৯৬২ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই জড়িয়ে যান শিক্ষা আন্দোলনে।
হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধে যাননি রোকেয়া কবির। ভোরের কাগজের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানালেন প্রস্তুতিপর্ব, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগড়ার সংগ্রাম সম্পর্কে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কেমন বাংলাদেশ রেখে যেতে চান-এমন স্বপ্নও ওঠে এলো দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। রোকেয়া কবির জানান, ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হই। কলেজ জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হই। গভ: ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের (বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ) এইচএসসির ছাত্রী আমি। ওই বছরই কলেজের ছাত্রী সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি ওই ছাত্রী সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হই। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হই। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সারাদেশ উত্তাল। আমরা দিনের পর দিন আন্দোলন করি। সত্তরের নির্বাচনে শ্রমিক, কৃষক আন্দোলনে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করি।
তার ভাষায়, সত্তরের নির্বাচনপরবর্তী ঘটনাবলি থেকেই যুদ্ধের একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েছিলেন ছাত্রসংগঠকরা। ফলে যুদ্ধের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা। তাই মিছিল, মিটিং, আন্দোলন, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ, ব্ল্যাক আউট হলে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কী করতে হবে- সেসব বিষয়ে মানুষকে জানানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ আয়োজনে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সেখানে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নিতেন নেতাকর্মীরা। ছাত্রী ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন তিনি।
রোকেয়া কবির বলেন, ৭ মার্চের ভাষণই মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা। আমরা আমাদের করণীয় বুঝে গিয়েছিলাম। আমি ভালো স্লোগান দিতে পারতাম তাই আমাকে সামনে দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীর চর্চা বিভাগের যে ডামি রাইফেল ছিল সেগুলো নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি সশস্ত্র সংগ্রাম কীভাবে করতে হয় সে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। বাঙালি যারা সেনাবাহিনীতে ছিলেন, তারা আমাদের প্রশিক্ষণ করাতেন।
দেশের সাধারণ মানুষকে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার সংকেত দেয়াই রাইফেল প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, মার্চপাস্টের সবার সামনে ছিলাম আমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি শহীদ মিনার, নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, কলাবাগান হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে গিয়ে শেষ হয়। মার্চপাস্ট করতে করতে আমরা যখন নগরীর বিভিন্ন সড়ক অতিক্রম করছিলাম তখন সাধারণ মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করছিল। এই মার্চপাস্টের মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আমরা একটা বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম। সেটি হলো- আলাপ আলোচলা করে সমস্যার সমাধান হবে না।
সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই দেশ স্বাধীন করতে হবে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ করলে আমরাও তা প্রতিহত করব এবং আমাদের ছাত্র সমাজ পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর মার্চপাস্টের ছবিটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে আর আমি হয়ে যাই ‘মোস্ট হান্টেট পারসন’। পার্টি থেকে আমাকে আগরতলা চলে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধের পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব দেয়া হয়। আমার নয় ভাইবোনের মধ্যে ছয়জনই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন।
রোকেয়া কবির জানান, ২৯ মার্চ ঢাকা থেকে নদীপথে কাপাসিয়ায় যাই। সেখান থেকে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে আগরতলা যাই। তখন শহীদুল্লাহ চৌধুরী (বর্তমানে টিইউসি সভাপতি) আমাকে ভারতে নিয়ে যান। তিনি আমাকে প্রধান সড়ক দিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। রাতের বেলা ধানের ক্ষেতের আল দিয়ে পায়ে হেঁটে আবার কখনো নৌকায় লুকিয়ে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে আমাদের দেশ থেকে অনেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে যায়, আমি দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় সেই অনুভূতি হয়েছিল। আর কখনো ঢাকায় বাবা-মার কাছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রেসকোর্স ময়দান, পল্টন এলাকায় ফিরতে পারব কিনা এটা ভেবে কষ্ট হচ্ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের এই সংগঠক জানান, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জ্ঞান চক্রবর্তীর সহকারী হিসেবে কাজ করতাম। ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রহ করতাম। তাদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিতাম। এছাড়া গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র ট্রেনিং যখন শেষ হত, তখন দেশের অভ্যন্তরে কীভাবে কে কোন পথে ঢুকবে এবং যুদ্ধ করবে সেই ব্যবস্থা আমাকেই করত হতো। এছাড়া ভারতে ক্যাম্পে ক্যাম্পে হাসপাতালের জন্য নার্স সংগ্রহ করা, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য পাঠাতাম। বিভিন্ন ক্যাম্পে শিশু-কিশোরদের স্কুলের ব্যবস্থা করেছেন, তাদের পড়ানোর জন্য ক্যাম্পের মধ্য থেকেই শিক্ষক খুঁজে বের করতাম। বই সংগ্রহ করতাম। আমি নিজেও ভূগোল, গণিত ও ইংরেজি পড়াতাম।
মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন কঠিন সময়ের কোনো ঘটনা এখনো আলোড়িত করে- এমন প্রশ্নের জবাবে স্মৃতিকাতর রোকেয়া কবির বলেন, ক্যাম্পে দিনের পর দিন নিরামিষ খেতে হতো। একদিন ছয় কেজি খাসির মাংস পাওয়া গেল ৩০০ লোকের জন্য। সবাই যে কী খুশি! অনেক বুটের ডাল দিয়ে রান্না করা হয়েছিল, যেন সবাই একটু মাংসের গন্ধ পায়। সবাই লাইন ধরেছিল ওটা খাওয়ার জন্য।
ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধা নারীদের কথা তেমনভাবে উঠে আসেনি- এই আক্ষেপ করে রোকেয়া কবির বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করাও হয়নি। এটি শুধু বাংলাদেশে তা নয়, সারা পৃথিবীতেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নারীরা কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেগুলোও কিন্তু ইতিহাসে ওইভাবে আসেনি। মুক্তিযোদ্ধা বললেই যে চিত্রটা আসে সেই চিত্র হলো আর্মস নিয়ে যুদ্ধ করা। আসলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা দু’টা দেশের আর্মির মধ্যে ছিল না।
এখানে সারাদেশের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার একটা ক্ষুদ্র অংশ লিস্টেট। বাকিরা লিস্টের বাইরে। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের গোবরা ক্যাম্পে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেক নারী। শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেবা দিয়েছেন অনেকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অংশ নিয়েছেন নারী শিল্পীরা। পথে-প্রান্তরে গান গেয়ে তারা অর্থ সংগ্রহ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। বিভিন্ন জায়গায় আনা নেয়া, গুপ্তচরের দায়িত্ব, পরিবারের পুরুষরা যখন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছে, তখন নারীই কিন্তু পরিবারের বয়স্ক, শিশুকে সামলে রেখেছে। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, রান্না করে পরম যত্নে খাইয়েছে। এসব অবদান কিছুই বৃথা নয়।
এদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২৪ ডিসেম্বর আগরতলা থেকে ঢাকায় চলে আসেন রোকেয়া কবির। আবার সংগঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তবে যুদ্ধ থেমে নেই বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ-বিএনপিএসের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবিরের। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী সারাদেশের ৪০০ নারীর তালিকা সংগ্রহ করে ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে শাহবাগে গণসংবর্ধনার আয়োজন করেন তিনি। ১৯৯৫ সালে ইয়াসমিন ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
নারীর মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি মন্তব্য করে এই নারীনেত্রী বলেন, সমঅধিকার এখনো ফাঁকা বুলি। সংবিধানে আছে, বাস্তবে নেই। সম্পদে সমান অধিকার নেই। নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ সম্পদে নারীর অধিকার না থাকা। বাল্যবিয়েরও কারণ এটি।
বিজয়ের ৫২ বছরে দাঁড়িয়ে কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে রোকেয়া কবির বলেন, আমরা ডিসেম্বর এবং মার্চ মাস এলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে, একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। যে সমাজে নারী-পুরুষে বিভেদ থাকবে না, পাহাড়ি-বাঙালি এই বৈষম্য থাকবে না। আমাদের সংবিধানেও তাই বলা আছে। কিন্তু বাস্তবে অসাম্প্রদায়িকতার বদলে ইসলামীকরণ বাড়ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে, এটি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। কিন্তু সামাজিক, মনোজাগতিক, মানবাধিকার, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হয়নি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমাদের থামিয়ে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ হতো সত্যিকারের সোনার বাংলা। উন্নয়নে সবস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়াই আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। এ লড়াই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সবাইকে।
Discussion about this post