কালাম আজাদ:
কক্সবাজারে দেশী বিদেশী সাহিত্যের বিখ্যাত লেখকদের গল্প, উপন্যাস, কাব্যের রুপান্তর করে নাট্যরূপদান এবং দেশের বিখ্যাত লেখকদের নাটকসহ ঐতিহাসিক নাটক মঞ্চায়নের পাশাপাশি ষাটের দশকের শেষ দিকে কক্সবাজারের নাট্যকর্মীরা মৌলিক নাটকের গুরুত্ব উপলব্ধি করে মঞ্চের প্রয়োজনে নিজেরাই অনেক নাটক লিখেছেন।
এ পর্বে কক্সবাজারের যে সব নাট্যকারের নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে তা প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক আলোচনা করা হচ্ছে।
১৯৬৭ সালে ওস্তাদ নুরুল মুক্তাদিরের রচনায় ও নির্দেশনায় ‘শপথ’, ‘আশার মানিক’ কক্সবাজার পৌর প্রিপ্যারেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ে মঞ্চায়িত হয়।
১৯৭৩-১৯৭৬ সময়কালে অধ্যাপক মুফীদুল আলম রচিত ও নির্দেশিত মৌলিক নাটক ‘কবন্ধ’ ও ‘লাবণী পয়েন্ট’, হিন্দি সাহিত্যের দিকপাল কৃষ্ণ চন্দ্রের গল্প অবলম্বনে রচিত ‘পাষাণ’ এবং ‘গলাকাটা লাশ’ নাটকটি কক্সবাজার সরকারি কলেজ এবং বর্তমান জেলে পার্কে প্রদর্শনী মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়।
১৯৭৪ সালে মাঘী পূর্ণিমা উদযাপন উপলক্ষ্যে রামুর শ্রীকুল মাঘী পূর্ণিমা উৎসব কমিটির উদ্যোগে মঞ্চায়িত হয় বিশিষ্ট ছড়াকার, নাট্যকার ধনিরাম বড়ুয়া রচিত ‘অঙ্গুলিমাল’ এবং ‘অজাতশত্রু’।
ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরীর রচনায় ও পরিচালনায় গণগীতিনাট্য ‘দুর্বার বাংলা’ ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং রামুর দর্শকদের প্রশংসা অর্জন করেন।
কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক গোলাম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কৃতিসন্তান ব্যাংকর খোরশেদ আলম বেশ কয়েকটি নাটক লিখেন এবং সেগুলো মঞ্চায়নও করেন বিভিন্ন সময়ে। খোরশেদ আলম রচিত ও নির্দেশনায় ‘আলীমুদ্দীনের দুঃস্বপ্ন, ‘পৃথিবীর ঘরে ঘরে’, ‘হুজুর কখন মরবে’, ‘মানবো না এ বন্ধনে’, ‘বোমা’ ও ‘আদম সুরত’। ‘মানবো না এ বন্ধনে’, বোমা’ এরশাদবিরোধী পথ নাটক। এ নাটক মঞ্চায়ন করতে পুলিশের তাড়াও খেতে হয়েছে। ‘আদম সুরত’ নাটকটি কক্সবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে বিটিভিতে সম্প্রচার করা হয়।
মাস্টার শাহ আলম উখিয়ার কৃতি সন্তান। একাধারে কবি, গল্পকার ও নাট্যকার। তিনি বেশ কয়েকটি নাটক নিজে রচনা করে উখিয়া, কক্সবাজার, রামু, চকরিয়া এবং চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নাটক মঞ্চায়ন করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। নিজস্ব রচনা ও পরিচালনার জন্য বেশ কয়েকটি পুরুষ্কারও পেয়েছেন তিনি।
মাস্টার শাহ আলম রচিত ও নির্দেশিত মঞ্চায়িত নাটকের মধ্যে ‘কবরের বুকে হিজল তরু’ (১৯৮৬), ‘একটি তারা একটি গোলাপ’ (১৯৮৮), ‘শুকনো ক্ষতে রক্ত’ (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯), ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের কঙ্কাল’ (২৬ মার্চ ১৯৯১), ‘অতঃপর ধানের শীষ’ (১৬ ডিসেম্বর ১৯৯২), ‘শয়তানের কামড় ’( ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২), আত্মসমর্পণ (১৫ জানুয়ারি ১৯৯৩), ‘একাত্তরের মলিন জ্যোতিস্ক’ (১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৩) ওদের ধরিয়ে দিন’ (১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭), ‘মাথিনের প্রেম কাহিনী’ (২২ ডিসেম্বর ১৯৯৭), ‘সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ চাই’ (১৯৯৮), ‘আন্তর্জাতিকতায় সমৃদ্ধ একুশ’ (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯), ‘রমজানের স্বপ্ন’ (১৯ জানুয়ারি ২০০৬), ‘হাজেরার পিরিতি’ (২০০৭), ‘আরকাইন্যা সুন্দরী’ (২৮ আগস্ট ২০০৮ ), ‘হাইস্যা বর হাতের লাঠি’ (৮ আগস্ট ২০০৯), ‘বিয়া হা গরালী’ (২০০৮), আঁরা তুয়ানরে ন ডরাই (২০১৮), বাল্যবিয়া (২০১৮), শিশুশ্রম (২০১৮) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
মাস্টার শাহ আলমের রচনায় ও পরিচালনায় বাংলাদেশ বেতার কক্সবাজারে প্রচারিত নাটিকার মধ্যে ‘অভিবাদন (২০১৪, ‘শোকাহত বাংলা’(২০১৪), কমিউনিটি ক্লিনিক (২০১৪), ‘আলোয় অবগাহন’ (২০১১), ‘বিচার চাই’ (২০১২), ‘তইলে বাজি আঁই নাই ’(২০১৪), ডিপথেরিয়া (২০১৭)।
রামুর প্রগতিশীল কবি-গীতিকার এবং নাট্যকার আশীষ কুমারের রচিত মঞ্চায়িত নাটকের মধ্যে গীতিনৃত্যু নাট্য ‘দুর্জয় বাংলা’ (১৯৮৫), ‘নিশীতের বিদীর্ণ ইতিহাস (১৯৮৫), ‘তেত্রিশ শালীর ভগ্নিপতি’ (১৯৮৭), ‘ক্ষমা নেই (১৯৮৮), আগুনে পোড়ানো ফাগুনের ইতিকথা (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮), এপ্রয়েনমেন্ট লেটার (১৯৮৯), ‘মর শালা পাবলিক (১৯৮৮-১৯৯১), ‘এ লাশ ঢাকা আসবে (১৯৮৯), একুশের জঠর থেকে স্বাধীনতা (১৯৮৯) অন্যতম। এসব ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রামু, আমিরাবাদসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সফল মঞ্চায়ন করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
মোহাম্মদুল হক ভাইয়া আঞ্চলিক নাটক ‘পানওয়ালী’ ও ‘বার্মাইয়া সুন্দরী’ রচনা করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
চকরিয়ার কবি ও শিশু কিশোর সংগঠক জওয়াদুল হক চৌধুরী রচিত ও নির্দেশিত নাটক ‘রণাঙ্গন’, ‘আগে তোরা মানুষ হ’, এবং ‘এসো দেশ গড়ি’ মঞ্চায়ন করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
১৯৯০ সালে বিজয় উৎসবে কক্সবাজার শহীদ দৌলত ময়দানে সত্যপ্রিয় চৌধুরী দৌলন রচিত ও নির্দেশিত মৌলিক নাটক ‘মুক্তিযোদ্ধার স্বাধ’ রিঙ্গণ নাট্য গোষ্ঠীর প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয়। তার রচিত ও নির্দেশনায় মঞ্চায়িত অন্য নাটকের মধ্য্যে হেমন্তিকা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর নাটক ‘মহারাণীর কাণ্ড’ (২০০৪), এবং গণমুখ থিয়েটারের কবি আসিফ নূরের কবিতা ‘অমাবস্যা দেখিলে গাঁয়ের মাইন্ষে কয়’র ভাব অবলম্বনে ‘অমাবস্যার হিস্যা’।
পরেশ কান্তি দে রচিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক শিশুতোষ নাটক ‘সূর্য্যরে সন্ধানে’ (১৯৯২) ঝিনুকমালা খেলাঘর আসরের সম্মেলনে মঞ্চায়ন করে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। এ ছাড়া তার রচনায় ও নির্দেশনায় ‘সখিনার একাল- সেকাল’ নাটকটি ২০১০ সালে কক্সবাজার পৌর প্রিপ্যারেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ে মঞ্চায়ন করা হয়।
কক্সবাজার গোলদিঘির পাড়ের সন্তান সঞ্জীব শর্মার রচিত ‘সুবজের বুকে লাল সূর্য জ¦লবে’ নাটকটি সিমুনিয়া নাট্যগোষ্ঠীর ব্যানারে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কক্সবাজার মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা, রামু বিজয়মেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৫তম সফল মঞ্চায়ন করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
আ.স.ম. শাহরিয়ার রচিত ‘মুকুট বিড়ম্বনা’ (১৯৯৩) নাটকটি কুতুবদিয়ায় মঞ্চায়িত হয়। জসিম উদ্দীন রচিত ও নির্দেশিত ‘জাতিশত্রু, ‘দূরে আলো’।
আবদুল মতিন আজাদ রচিত ও নির্দেশিত ‘স্বাধীনতা একটা রক্তাক্ত বিলাপ’, ‘চাঁদকুমারী’। আবদুল মতিন আজাদের আঞ্চলিক নাটক ‘চাঁদকুমারী’ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ১৪৫তম সফল মঞ্চায়ন করা হয়।
কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার মৌনকুমারী, জন্মজাতি এবং আমরা তামাটে জাতি’ অবলম্বনে কামরুল হাসান রচিত ও নির্দেশিত ঝিনুক নাট্যকেন্দ্রের মৌলিক নাটক ‘মৌন কুমারী ও তামাটে কিশোর’ (১৯৯৪), ‘মোক্তার বলি ও নাফকন্যা ম্যামাচিং’ (২০১০), হেমন্তিকা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর পরিবেশনা ‘মুক্তিযুদ্ধ ফিরে ফিরে ডাকে’ (২০১৯), ‘রোয়াইঙ্গা শরণার্থী বিরাঙ্গনা সাফিয়া’।
পরিতোষ চক্রবর্তী বাবুল রচিত ‘একটি বিলুপ্ত সভ্যতার গর্ভধারণী’ এবং ‘রক্তেভেজা পতাকা’, সাংবাদিক দীপক শর্মা দীপুর রচিত শ্রী কৃষ্ণ লীলা (২০০৪) এবং দুর্গেশনাশিনী (২০০৮) জসিম উদ্দিন বকুল রচিত ‘সূর্য উড়ের লাল মারি’ (২০০৫)।
কক্সবাজারের প্রগতিশীল কবি ও সাংস্কৃতিক কর্মী রহমান মুফিজের রচনায় ও নির্দেশনায় ‘ক্রান্তিবাস (২০০৬)’, গীতিনৃত্য নাট্য ‘দইজ্জার ফুল (২০০৬), পথ নাটক ‘মানুষ জাগবে ফের (২০০৬), ‘জাতিস্মর সাম্পান’ উদীচীর নাটক বিভাগের উদ্যোগে মঞ্চায়িত হয়।
কক্সবাজারের প্রবীণ অভিনেতা ও নাট্যজন বাবুল পাল ‘সোনা বিবির বিয়া (২০০৪) এবং ‘হাসিনা বানুর হঁলা ও হাসি’ নাটক রচনা ও মঞ্চায়ন করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। উভয় নাটকে কক্সবাজারের স্থানীয় অভিনেতা-অভিনেত্রীর পাশাপাশি জাতীয় শিল্পীরা অভিনয় করে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নাটকের লেড়া মিয়া খ্যাত অভিনেতা ডুলাহাজারার উত্তম কুমার ‘জীবনের রং’, ‘লুইচ্ছা ফেরিওয়ালা’, ঘুষখোর পুলিশ মেরা মিয়া, লেড়া মিয়ার নকল বউ, লেডা মিয়ার রং-চা, ‘বউ পলাতক, নাঠা মানুষ, বিয়ার আসরে ডায়রিয়া, মেয়ে বিছানায় মুতে, ডিজিটাল বউ, লেডা মিয়ার সুন্দরী বউ, ‘ধান্দা পুলিশ’, ‘তিন থাপ্পরের সংসার’, চাঁপাবাজী’, ‘ভাড়াইট্যা জামাই’, ‘খানদানী বংশ’, ‘মদদি জামাই’, ‘কেয়ামত এর আলামত’, ‘মেয়াদ উত্তীর্ণ মাল’, ‘মেরা মিয়া মহিলা সমিতির সভাপতি’, ‘গামছা বাবা’ ‘বউ মরা এতিম’, ‘তিন বলদ’, ‘গোপন ব্যবসা’, ‘বন্ধুর বউয়ের সাথে প্রেম’, ‘চুতিয়া গীরি’, ‘মেরামিয়ার বৌ তালাক, ‘দুই প্রেমিক’, ‘সুখী ও উয়াশ্যা’, ‘বিয়াইনের পরকীয়া’, ডান্ডা মারি ঠান্ডা, ‘ বেওয়ারিশ লাশ’, ‘জামাই শ্বশুর বয়রা’, ‘লাশে বিডি টানে’, বুরা বুরির প্রেম’ সহ শতাধিক নাটক রচনা ও পরিচালনা করেন।
২০১৩ সালে তাপস মল্লিকের রচিত যুদ্ধাপরাধী বিষয়ক নাটক ‘অস্তিত্ব ৭১’ থিয়েটার রামুর উদ্যোগে রামু বিজয় মেলা এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে মঞ্চায়িত হয়।
রামুর আবুল কাসেম রচিত ‘শিক্ষার দাম’ নাটকটি বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আয়োজিত জেলা ও বিভাগীয় র্পায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ঢাকায় শিশু একাডেমিতেও সফল মঞ্চায়ন হয়। আবুল কাসেমের রচনা ও পরিচালনায় মঞ্চায়িত অন্য নাটকের মধ্যে ‘বিয়ে পাগল’, ‘জলপরী, বাঁকখালীর মাঝি’, ‘দিশারী’ প্রভৃতি।
উদীচী কর্মী জিয়ন্ত রাজু রচিত মঞ্চায়িত নাটকের মধ্যে ‘ বর্তমান’, ‘গোলাপী’, ‘রেডিও’ ‘ মহল্লা’, ‘আধুনিক দূর্গা’।
কক্সবাজারের সন্তান না হয়েও অনেকই পেশাসূত্রে কক্সবাজারে অবস্থান করে নাট্যাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাদের অন্যতম স্বপন ভট্টাচার্য ও মমতাজ উদ্দিন আহমদ। তারা উভয়ে পেশার সূত্রে কক্সবাজার শহরে অবস্থান করেছেন।
স্বপন ভট্টাচার্য পেশা সূত্রে ১৯৯৩ সাল থেকে কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। তার রচিত ও ও রূপান্তরিত নাটকের মধ্যে ‘পুতুলখেলা’, ‘প্রজন্মের অঙ্গীকার’, ‘দুষ্টু মোরগ’, ‘ট্রাংক রহস্য’, ‘অভীপ্সিত, ‘সম্পর্কের আবর্তে’, ‘নীল সমুদ্রের ঝড়’, ‘যখন বৃত্তের বাইরে’, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’, ‘দেনাপাওনা’, ‘আত্মদহন’, ‘বাঁধ ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব’, ‘শব্দের বিজয়গাঁথা’ ও ‘মনবৈরি’ উল্লেখযোগ্য।
নাটকগুলি কক্সবাজার থিয়েটার, থিয়েটার আর্ট কক্সবাজার, কক্সবাজার সিটি কলেজ এবং কক্সবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনায় মঞ্চায়ন হয়।
মমতাজ উদ্দীন আহমদ রচিত ‘স্বাধীনতার মূলমন্ত্র’ গণমুখ থিয়েটারের উদ্যোগে পরিবেশন করা হয়।
লেখক: কালাম আজাদ, সাংবাদিক, কবি ও গবেষক।
Discussion about this post