(আমাদের শৈশবের কক্সবাজার অনেকটা বদলে গেছে। চেনা শহরটা অচেনা মনে হয়। কিন্তু কিছু সমৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই পুরনো একটি লেখা আবার প্রকাশ করলাম। প্রথম প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর, ২০২০)
ছোটবেলা থেকেই আমার প্রচন্ড দূর্বলতা জিন্সের কাপড়ের প্রতি। শ্রমিকদের জন্য তৈরী এই প্যান্ট ১৯৫০-এর দশক থেকে কিশোরদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আমাদের দেশে এক সময় মুরব্বিরা মনে করত এটা বখাটেদের ড্রেস। জিন্স পড়া ছেলেদের অনেকটা বেয়াদব মনে করা হত। স্যারেরাও নিষেধ করতেন জিন্স না পড়তে। অনেক প্রতিষ্ঠানে ড্রেস কোড হিসেবে এটা নিষিদ্ধ। তাই এটা অনেকে এভয়েড করেন।
কিন্তু আমার কেমন জানি উল্টোটাই হত। জিন্স পড়লে শরীরে একধরনের ফিলিংস হত। সাচ্ছন্দ্য বোধ হত। যত্রতত্র বসতে সমস্যা হত না। কালারটা যত ফেইড হত তত বেশী ভাল লাগত। মাঝে মাঝে জিন্সের উল্টো দিকটাও সেলাই করে পড়েছি।
৮০ দশকের একটা কথা আজো ভুলতে পারিনি। লালদিঘীর পাড়ে তৎকালীন জেলা আওয়ামীলীগ অফিসের সামনে ছাত্রনেতা পেয়ারো ভাই (কামাল উদ্দিন পেয়ারো) একটা টেইলার্স দিয়েছিলেন। এটাতে বেশিরভাগ ইয়াং ছেলেপেলে জিন্সের প্যান্ট সেলাই করত। জিন্সের প্যান্টে সাইট ও ব্যাক পকেট ভালভাবে লাগাতে পারতেন বলে আমিও সেখানে প্যান্ট সেলাই করাতাম। তখন কিন্তু রেডিমেড জিন্স প্যান্ট পাওয়া যেত না।
ইন্টারে পড়াকালীন দাদার শখ নাতিকে একটা স্যুট সেলাই করে দেবে। (বলে রাখা ভাল, আমার ৬ মাস বয়সে পিতার মৃত্যু হলে দাদাই পিতার ভূমিকা পালন করেন।) তিনি সৌদি আরবের প্রবাসীর কাছ থেকে গিফট পাওয়া একটা স্যুটের কাপড় আমাকে দিলেন। সাথে সেলাইয়ের টাকা। আমি কাপড়টা পেয়ারো ভাইকে বিক্রি করে দিই। এই টাকায় একটা জিন্সের প্যান্ট সেলাই করি, বাকী টাকা নিজে খরচ করে ফেলি।
এদিকে আমার দাদা তাগাদা দেয়, তোর স্যুট কই! আমি আজ আনব, কাল আনব, করতে করতে অনেকদিন হয়ে যায়।
একদিন খুব বকাবকি করলেন আমার দাদা। নিজেকে বাঁচাতে দোষ দিলাম টেইলার্সের। আমার দাদা ছিলেন খুবই রাগী মানুষ, জমিদার হলে যা হয়। – বল কোন টেইলার্স।
আমি পেয়ারো ভাইয়ের এই টেইলার্সের নাম বলার পরে তিনি সেখানে যেতে রেডি হচ্ছিলেন। কোন রকম বুঝিয়ে একদিন পরে যাওয়ার জন্য রাজী করালাম।
এদিকে তার আগে পেয়ারো ভাইকে ধরলাম। ভাই আমাকে বাঁচান। ওনি আপনার কাছে আসতে চাচ্ছেন স্যুট কেন দিচ্ছেন না জানতে। তিনি অভয় দিলেন, আমি তোমার দাদাকে ম্যানেজ করে নেব।
পরের দিন দাদা গেলেন পেয়ারো ভাইয়ের এন্ডারসন রোডের বাসায়। একটা প্যান্ট পিস আর টাকাটা আগে থেকে ম্যানেজ করে রেখে আমাকে সে যাত্রা রক্ষা করেছিলেন। আমার জিন্স প্রীতির কারণে মাঝখানে নিরপরাধ পেয়ারো ভাই আমার জন্য প্রচুর গালি শুনেছিলেন। তিনি নীরবে হজমও করেছিলেন।
সত্তরের দশকে আমি স্কুল ছাত্র হলেও আজো মনে পড়ে আমার বড় বোনের হাই হিল পড়ার কথা। খুব ইচ্ছে করত আমিও পড়ি। না দেখেমত পায়ে দিয়ে ২/৩ কদমের বেশী চলতে পারতামনা। পা টা বাকা হয়ে হিল থেকে পড়ে যেতাম।
অনেককে দেখতাম লম্বা চুল, লম্বা শাটের কলার, বিশাল পায়ের ঘের। আস্ত বেল্ট। মনে হয় ওটাকে বেল বটম জমানা বলা হত। তখন আমি কক্সবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র।
আমিও শখ করে ফায়ার ব্রিগেডের সামনে এডভোকেট ফজল উকিলের মার্কেটের লাইনে একটা টেইলাসে পায়ের দিক থেকে প্রায় ১৬ ইঞ্চি লম্বা ঘের প্যান্ট সেলাই করতে দিয়েছিলাম। ডেলিভারি নিতে গিয়ে দেখি এক ইঞ্চি কম। মেজাজ গেল বিগড়ে। আস্ত এক ইঞ্চি কমায়ে ফেলেছে বেটা! পারলে কিলাই।

এক ইঞ্চি কমের কারণ জানতে চাইলে টেইলার্স ওয়ালার উত্তর,- এত ছোট বাচ্চা, যে লম্বা পায়ের ঘের দিছ, কাপড়ে কুলায় নাই। এ কথা শোনার পর খুব অপমান লাগল, মনটাও ভেঙ্গে গেল। বেশি ছোট ছিলাম, বকাসকা করতে না পেরে সেদিন অশ্রুসজল নয়নে চলে এসেছিলাম।
বাটা রোডে একটা টেইলার্স ছিল। উখিয়াওয়ালা বলে সেখানে বেশী যাওয়া হত। গতানুগতিক শার্ট সেলাই না করে একটা এ.বি.সি.ডি অক্ষরওয়ালা কাপড় নিলাম। বললাম ২টা ডিম পকেট বানিয়ে দিতে। মানে গোলাকৃতির। এটা সেলাইয়ের পর সমস্যা হয়ে গেল গোল হওয়াতে পকেটে কিছু রাখতে পারতামনা। তারপরও ফ্যাশন বলে কথা । গোল পকেট নিয়ে গর্ববোধ করতাম বৈকি। বন্ধুরাও ধরে ধরে দেখত। জানতে চাইত কোন টেইলার্স।
কসকরের ভুচকী কাপড়ের কথা আজো মনে পড়ে। সিকদার মহলের নিচে ন্যায্য মূল্যের দোকানে পাওয়া যেত। অনেক সস্তা। আরাম লাগত। তবে সমস্যা ছিল সব সময় ইস্ত্রি দেয়া লাগত। কুচকে যাওয়া কাপড়কে তখন ফ্যাশন মনে করত না। কিন্তু আটোসাটো গায়ে লেগে থাকা কাপড় সার্ট হিসেবে আমার ভাল লাগত।
ফ্যাশনের দিক থেকে কক্সবাজার তখন ঢাকার সাথে পাল্লা দিত। টেইলার্স হিসেবে যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছিল ডিসেন্ট টেইলার্স। রয়েল টেইলার্স, ন্যাশনাল টেইলার্স, রিসেন্ট টেইলার্স, মাইকেল ফ্যাশন টেইলার্স অন্যতম ছিল। তখন বিদেশী পর্যটকের আনাগোনা বেশী ছিল।
এছাড়া ভিসিআর হলগুলোতে চলা হিন্দী ফিল্মের ড্রেসের ফ্যাশন কক্সবাজারের টিনেজারদের বেশী আকর্ষণ করত। তবে আমাকে বেশী টানত মাইকেল জ্যাকসন। তার ছবি রুমে ঝুলিয়ে রাখতাম।
কক্সবাজারের ফ্যাশনে কারাতে ড্রেসের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। কক্সবাজারকে বাংলাদেশের কংফু কারাতের পীটভূমি বললে অত্যুক্তি হবেনা। কংফু কারাতে অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। এলাকা ভিত্তিক কারাতে ক্লাব গড়ে উঠে। এরমধ্যে কারাতে মনজুর, কারাতে আবু, কারাতে সিরাজ ইত্যাদি ওস্তাদের নামে ক্লাবগুলো চলত। ভিসিআর হলে চাইনিজ ফিল্মও খুব পপুলার ছিল।
বিশেষ করে ব্রুসলীর ফিল্ম। এ কারণে ফ্যাশনেও এর প্রভাব দেখা যেত। তখন ‘কংফু স্যু’ বেশ জনপ্রিয় ছিল। জিন্স প্যান্ট আর কংফু স্যু পায়ে দিলে গায়ে কেমন জানি উড়ু উড়ু ভাব হত।
টিনেজারদের দেখতাম একে অপরের সাথে হাতে পায়ে মারামারি করছে – মুখে আওয়াজ – ইয়াহ , ইয়াহু – ইয়াহ আলী.. !
তারপর দেখতাম কারো ঠোট ফেটে গেছে, কারো মুখ গোল আলুর মত হয়ে গেছে। এরপর দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে যার যার পথে চলে যেত।
তবু বলব, এখনকার গোলাগুলির চেয়ে তখনকার এ মারামারি অনেক ভাল ছিল বৈকি!
[নোট: আমার আলোচনা একটা খন্ডিত স্মৃতিচারণ। এটা কক্সবাজারের টোটাল ফ্যাশন এর ইতিহাস নয়। বাম পাশের ছবিটা আমার ১৯৮৬ সালের। আর বেল বটম ছবিটা বাহারছড়ার পুরাতন সায়মন হোটেলে। ছবির চরিত্রগুলো অজানা। এটা ফেসবুক থেকে সংগৃহীত]
লেখক: সম্পাদক, কক্সবাজার নিউজ ডটকম।
Discussion about this post