কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে কোনো প্রকার সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে একটি প্রভাবশালী বেপরোয়া চক্র পাহাড় কেটে ধ্বংস করছে প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যকে। বেশ কিছু স্থানে প্রতিনিয়ত শ্রমিক দিয়ে পাহাড় কাটাচ্ছেন। এতে জীববৈচিত্র্যসহ বন ভূমি ধ্বংসের পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব থাকায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মূলত বছরের শেষ দিকে উখিয়া উপজেলার ইটের ভাটাগুলোতে মাটি সরবরাহের জন্য পাহাড় কাটার উৎসব শুরু হয়। তবে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের অজুহাত দেখিয়ে বছরজুড়েই পাহাড় কাটছে কয়েকটি চক্র। কমিশনের বিনিময়ে তাঁদের সমর্থন দিচ্ছেন উখিয়ার বেশ কিছু প্রভাবশালী নেতা।
অভিজ্ঞ মহল মনে করেন এ ভাবে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসহ পরিবেশের যে ক্ষতি হবে তা পুষিয়ে উঠা সম্বব নয়। পাহাড় কাটা বন্ধে দ্রুত প্রদক্ষেপ না নিলে আশঙ্কা রয়েছে ভূমিকম্প বা লাগাতার বর্ষণের সময় ভূমিধস হয়ে বড় রকমের বিপর্যয় হতে পারে।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার পালংখালীর মুছারখোলা, রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণমারা, উত্তর পুকুরিয়া ও জামতলী, হাজিরপাড়া, জালিয়াপালং এর জুম্মা পাড়া ও বাগানের পাহাড়, হলদিয়া পালং ইউনিয়নের লেঙ্গুরবিল, খেলাসিপাড়া ও পাতাবাড়িসহ প্রায় ২৫টিরও বেশি স্থানে বন ভূমির পাহাড় কেটে মাটি মিনি ট্রাকে (ডাম্পার) করে ইটভাঁটাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একেকটি স্থান থেকে দিনে ২০ ট্রাকেরও বেশি মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
জানা যায়, জালিয়া পালং ইউনিয়ন মুনাফ মার্কেট এলাকার মৃত হাজী ছৈয়দ আহমদের ছেলে আবুল কালামের নেতৃত্বে রাজাপালং এর হরিনমারায় পাহাড় কাটা হচ্ছে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আবুল কালাম ও তার সহযোগীরা পাহাড় কেটে মাটি অন্যত্র বিক্রি করছে। তার সহযোগীরা প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না।
এ ব্যাপারে জানতে আবুল কালামের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি অস্বীকার করে জানান, আমি কোন পাহাড় কাটতেছিনা। আমি সরকারিভাবে ইজারা নেয়া খাল থেকে বালি উত্তোলন করে বিক্রী করতেছি।
পালংখালী মোছার খোলায় গেলে দেখা যায় চারজন পাহাড় কাটা শ্রমিক। তাদের মধ্যে তিনজন পালিয়ে গেলেও মিজান (২৭) নামের একজন রোহিঙ্গা শ্রমিক বলেন, কেউ একজন তাদের মাটি কাটার জন্য এখানে নিয়োগ দিয়েছেন। ঐ ব্যাক্তির নাম তারা জানেন না। সকাল সাতটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত পাহাড় কাটার বিপরীতে দৈনিক ৪০০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। চার দিন ধরে পাহাড় কাটলেও কেউ তাঁদের নিষেধ করেনি।
রাজাপালং পশ্চিম হরিণমারায় সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহে গেলে দেখা যায় বনবিভাগের পাহাড় ধসিয়ে উঁচু উচুঁ বালির পাহাড় করে রেখেছে পাহাড় খেকোরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব বালির পাহাড় করে রেখেছে উখিয়ার আরমান নামের এক পাহাড় খেকো। বেশ কিছু পাহাড় ধসিয়ে কোটি টাকার বালির পাহাড় করে রেখেছেন এই আরমান। ছোট থেকে শুরু করে বৃদ্ধের মুখেও আরমানের নাম শোনা যায় হরিণমারায় গিয়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক কৃষক বলেন, পাহাড় ধসিয়ে বালু উত্তোলন করে পাহাড় বানিয়ে রাখার কারনে অকেজো হয়ে গেছে প্রায় ৬০ শতক চাষাবাদ করার জমি৷ আমাদের পেটে লাথি মেরে এসব বালি উত্তোলন করা হচ্ছে, আর আমাদের জমি নষ্ট করতেছে। আমরা সরকার ও বনবিভাগের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
পাহাড় ধসিয়ে বালি উত্তোলনের ব্যাপারে জানতে আরমানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পাহাড় কেটেছি একবছর আগে, কিন্তু এখন না। আমি আগে অবৈধ বালি উত্তোলন করতাম। আগে কক্সবাজার থেকেও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সহ এসে আমার দুটি ম্যাশিন জব্দ করেছিলেন। আমার জন্য মামলাও দিয়েছে। তবে আমরা এখন খাল থেকে বালি তুলতেছি। এখন অবৈধ না আমি, বৈধ তুলতেছি। আমি সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিছি।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমার ইউনিয়নে ব্যাপক হারে পাহাড় নিধন করতেছে পাহাড় ও বালি সন্ত্রাসীরা। খালের ইজারাদারের কথা বলে পাহাড় নিধন করলেও এ ব্যাপারে ইজারাদার অবগত আছেন কিনা তা আমার জানা নেই। পাহাড় নিধন বন্ধের জন্য আমি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। পাহাড় রক্ষায় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন উখিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জসিম আজাদ বলেন, পাহাড় কাটার বিষয়ে আমরা সুশীল সমাজ প্রতিবাদ করে আসছি। প্রশাসন কখনও কখনও ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও আবার থমকে যায়। পাহাড় কাটার মতো জঘন্য অপরাধমূলক কাজটি প্রশাসন ও বনবিভাগের রহস্যজনক নিরবতায় এখন অনেকটা বৈধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সমূহ ব্যর্থ। পাহাড় রক্ষায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইমরান হোসাইন সজিব জানান, পাহাড় কাটা সম্পূর্ণ একটি বেআইনি কাজ। এটি কোনোভাবে গ্রহণ যোগ্য নয়। এরকম অবৈধ পাহাড় কাটার বিষয়ে আমার কাছে কোন তথ্য নেই। তবুও এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে খতিয়ে দেখছি।
Discussion about this post