সৈয়দ মুহাম্মদ রিজবান উল্লাহ
পাওয়ার অব এ্যাটর্নী:
যে আইনগত দলিলের মাধ্যমে কাউকে বিশেষ প্রয়োজনে নিজের ক্ষমতা অন্য জনকে অর্পন করা হয় সেই দলিলকে আইনের ভাষায় পাওয়ার অব এ্যাটর্নী বলা হয়।স্থায়ী,অস্থায়ী সম্পত্তি অথবা অনুপস্থিতিতে কোন কার্য সম্পাদন করার জন্য ক্ষমতা অন্য এক বা একাদিক ব্যাক্তির উপর পাওয়ার অব এ্যাটর্নী বা আমমোক্তার নামা মুলে প্রদান করা হয়ে থাকে।
পূর্বে ১৮৮২ সালের আইন দ্বারা পাওয়ার অব এ্যাটর্নী সম্পাদন করা হত। উক্ত আইন বাতিল করে ২০১৩ সাল হতে পাওয়ার অব এ্যাটর্নী আইন, ২০১২ এর অধীনে বর্তমানে এটি সম্পাদন করা হয়।
পাওয়ার অব এ্যাটর্নী আইন, ২০১২ এর ধারা ২(১) “পাওয়ার অব এ্যাটর্নী” অর্থ এমন কোন দলিল যাহার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি তাহার পক্ষে উক্ত দলিলে বর্ণিত কার্য-সম্পাদনের জন্য আইনানুগভাবে অন্য কোন ব্যক্তির নিকট ক্ষমতা অর্পণ করেন’।
যেভাবে করবেন আমমোক্তার নামা:
আমমোক্তার নামার বা পাওয়ার অব এটর্নীর মাধ্যমে কোন দায়িত্ব বা ক্ষমতা অর্পন করতে হয়।আমমোক্তার নামা দলিলে ক্ষমতা অর্পন বিষয়ে শর্তাবলী সু-স্পষ্ট এবং সুনিদির্ষ্ট ভাবে উল্লেখ করতে হবে যেন যাকে ক্ষমতা দেওয়া হল তিনি কি কি কাজ করতে পারবেন বা পারবেন না তা বুঝা যায়।
সাধারণত আমমোক্তারনামা দুই প্রকার যথা:
১) সাধারণ মোক্তারনামা।
২) খাস মোক্তারনামা, যা বিশেষ মোক্তারনামা।
যে আমমোক্তার নামার মাধ্যমে মোক্তার দাতার পক্ষে জমি-জামা ক্রয়, বিক্রয় রক্ষণা-বেক্ষন, চুক্তিপত্র করা, মামলা মোকাদ্দমা পরিচালনা করা সহ যাবতীয় কাজের ক্ষমতা মোক্তার কে দেওয়া হয় তাকে জেনারেল পাওয়ার অব এটর্নী বা সাধারণ মোক্তারনামা বলে ।
অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট বা কোনো বিশেষ কাজের ক্ষমতা অর্পন করা হলে তাকে, স্পেশাল পাওয়ার অব এটর্নী বা খাস মোক্তারনামা বলে।
সাধারণত যেসকল আমমোক্তারনামা স্থাবর সম্পত্তি বা জমিজমা হস্তান্তরের সঙ্গে জড়িত নয়, সেগুলো নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে নোটারি করে নেওয়া যায়। কিন্তু স্থাবর সম্পত্তি বা জমিজমা সংক্রান্ত আমমোক্তারনামা অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হবে।
অন্যথায় হলে এর আইনগত ভিত্তি থাকবে না।মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি নিয়ে পাওয়ার অব এ্যাটর্নী এর মাধ্যমে অন্যজন কে দায়িত্ব দেওয়া যায়।দলিলের ধরন অনুযায়ী নির্দিষ্ট মূল্যের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে আমমোক্তার নামা সম্পাদন করতে হবে।
যেসকল আমমোক্তারনামা রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক, এরুপ আমমোক্তারনামা সম্পাদনের তিন মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। মোক্তারনামা দাতার সম্পত্তি যেখানে থাকুক না কেন, দাতা যেখানে বসবাস করেন সে জেলার রেজিস্ট্রি বা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
বিদেশে অবস্থানরত ব্যাক্তি কর্তৃক সম্পাদন:
বিদেশে বসবাসরত কোন ব্যাক্তি পাওয়ার অব এটর্নী করতে চাইলে তা ওই দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস কর্তৃক প্রত্যয়ন করে বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। এর পর তা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সহকারী সচিব কর্তৃক সত্যায়ন বা প্রমাণীকরণ করতে হবে।
এর পর তা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের রাজস্ব কার্যালয়ে জমা দিয়ে নির্দিষ্ট মূল্যের স্ট্যাম্প লাগাতে হবে। এই পর্যায়ে ওই দলিলের একটি ক্রমিক নম্বর ও তারিখ নির্দিষ্ট হবে। এই নম্বরটিই হবে ওই পাওয়ার অব এ্যাটর্নী দলিলের নম্বর। পাওয়ার অব এটর্নী দলিল সম্পাদনের ৩ মাসের মধ্যে জেলা প্রশাসকের নিকট দাখিল করতে না পারলে ১৮৯৯ সালের স্ট্যাম্প এক্ট এর ৩৩ ধারা মতে সাধারন ফিসের ১০ গুন বেশী ফিস দিয়ে তা নিয়মিতকরন করা যাবে ।
আমমোক্তার নামা বাতিল:
যেকোনো সময় সাধারণ আমোক্তারনামা বা পাওয়ার অব এ্যাটর্নী বাতিল বা প্রত্যাহার করা যায়। যে অফিসে আমোক্তারনামা দলিলটি রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল, সেই জেলার রেজিস্ট্রার বরাবর আমমোক্তারনামা বাতিলের জন্য আবেদন করতে হবে।
এ ছাড়া নোটারির মাধ্যমে করা আমমোক্তারনামা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমেই বাতিল করতে হবে। সাধারণ পাওয়ার অব এ্যাটর্নী বাতিল বা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে দাতা ক্ষমতা গ্রহীতাকে রেজিস্টার্ড ডাকের মাধ্যমে ৩০ দিনের নোটিশ দিয়ে প্রদত্ত ক্ষমতার অবসান ঘটাতে পারবে। এছাড়াও ক্ষমতা গ্রহীতাও একইভাবে দাতাকে ৩০ দিনের নোটিশ প্রদান সাপেক্ষে অ্যাটর্নীর দায়িত্ব ত্যাগ করতে পারে।
আমমোক্তারনামা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য করা হলে উক্ত মেয়াদ শেষে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। একইভাবে নির্দিষ্ট কাজের জন্য করা মোক্তারনামা ওই কাজের সমাপ্তিতে বাতিল বলে গণ্য হবে। যৌথ ক্ষমতার মোক্তারনামার পক্ষদের একজনের মৃত্যুতে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
মোক্তারনামা দাতা কোনো মোক্তারনামা বাতিল করতে ইচ্ছুক হলে যে রেজিস্ট্রি অফিসে মোক্তারনামাটি রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল, উক্ত জেলার রেজিস্ট্রার বরাবরে মোক্তারনামা রদের জন্য আবেদন করতে হবে। মোক্তারনামার ওপর তিনি ‘রদ করা’ কথাটি লিখে দেবেন।
এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই রেজিস্ট্রার তা সংশোধন করবেন। রেজিস্ট্রি অফিসার মোক্তারনামা বাতিলের আবেদন পাওয়ার পর, তার জেলার সকল রেজিস্ট্রার অফিসে বা অন্য কোনো জেলার সদর অফিসকে বিষয়টি নোটিশের মাধ্যমে জানিয়ে দেবেন। নোটিশ জারির ডাক টিকিটের খরচ আবেদনকারীকেই বহন করতে হবে।
বিরোধ নিষ্পত্তি:
রেজিস্ট্রেশন আইনের অধীনে রেজিস্ট্রিকৃত পাওয়ার অব এ্যাটর্নী নিয়ে যেকোনো বিরোধের ক্ষেত্রে পক্ষগণ প্রথমে নিজেদের মধ্যে আপসে মীমাংসার চেষ্টা করবেন। এ ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হলে একজন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা চালাবেন।
এখানেও ব্যর্থ হলে পক্ষদ্বয় আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন। কোনো পাওয়ার অব এ্যাটর্নী প্রত্যাহার,অবসান বা বাতিলের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালা, ২০১৫ এর বিধি ১২ ও ১৩ অনুযায়ী পাওয়ারদাতা বা গ্রহীতা বা তাদের বৈধ প্রতিনিধি বা অন্য কোনো স্বার্থযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক বিধিমালায় উল্লিখিত তফসিল ‘খ’-তে নির্ধারিত ফরম মোতাবেক একটি নোটিশ, সংশ্লিষ্ট সাব রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের ১ নম্বর বইয়ে নথিভূক্ত করার জন্য উপযুক্ত কর্মকর্তার কাছে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের উদ্দেশ্যে দাখিল করবেন।
লেখক: সৈয়দ মুহাম্মদ রিজবান উল্লাহ,
আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম
Discussion about this post