কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশনের জন্য ‘উপজেলা পর্যায়ে’ ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবক এর সম্মানী ভাতার জন্য বরাদ্দের ৮লাখ টাকা নামে-বেনামে স্বেচ্ছাসেবকের তালিকা দেখিয়ে পকেটস্থ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা! স্বেচ্ছাসেবকদের নামে-বেনামে তালিকা দেখিয়ে সরকারী বরাদ্দের টাকা লোপাটের ঘটনাটি গত কয়েকদিন পূর্বে ফাঁস হলে পেকুয়াজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বরাদ্দের টাকা লোপাটের ঘটনায় সরাসরি জড়িত রয়েছে পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মাজেদ চৌধুরী ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার মুজিবুর রহমান। তবে আবাসিক মেডিকেল অফিসার বরাদ্দের টাকা লোপাটের বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করলেও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মাজেদ চৌধুরীর কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও তিনি এ প্রতিবেদককে কোন প্রকার বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশনের জন্য ‘উপজেলা পর্যায়ে’ স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য ডিসেম্বর ২০২১ইংরেজী থেকে জুন ২০২২ইংরেজী পর্যন্ত ৫টি টিমে প্রতিটিমে ৩জন করে মোট ১৫জন স্বেচ্ছাসেবকের জন্য ৮লাখ ৮২হাজার টাকা বরাদ্দ আসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে।
কিন্তু ১৫জন স্বেচ্ছাসেবকের নামে বরাদ্দ আসলেও ভেকসিনেশন কর্মসূচী চলাকালীন সময়ে তালিকায় নাম থাকা কোন স্বেচ্ছাসেবকই পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি। বরাদ্দের টাকা ‘জায়েয’ করতেই পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও আবসিক মেডিকেল অফিসার নিজেদের ‘মনগড়া’ একটি তালিকা তৈরী করেন। উক্ত তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৫জন স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে ৮জনই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মুজিবুর রহমানের স্ত্রীর মালিকানাধীন নুর হাসপাতালে কর্মরত নার্স, ওয়ার্ড় বয় ও স্টাফের নাম।
আর ৭জনের মধ্যে এনজিওতে কর্মরত কয়েকজন, হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মাজেদ এর এলাকার বাসিন্দা চকরিয়ার সাহারবিলের পিতা-পুত্রের নাম রয়েছে। মাস্টার রোলে আরো কয়েকজনের নাম থাকলেও তাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তালিকায় ৮ নং ক্রমিকে মো: মুনির উল্লাহ মুনিরী নামের একজনের নাম থাকলেও এ ব্যক্তির অস্তিত্ব পেকুয়ায় পাওয়া যায়নি। অথচ মুনিরীর নামে স্বাক্ষর দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক সম্মানীর ৫৮ হাজার ৮’শ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
তালিকায় ১২ ও ১৩ নং ক্রমিকে নাম রয়েছে মো: ওবাইদুল হাকিম ও শপিকুল হাকিম হাছনার। তারা উভয়ই পিতা-পুত্র। তারা পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মাজেদ চৌধুরীর এলাকা চকরিয়ার সাহারবিলের বাসিন্দা। শফিকুল হাকিম হাছনা পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোভিড ভ্যাকসিনেশন চলাকালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেনি।
এ বিষয়ে ফোনে শপিকুল হাকিম হাছনার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার পিতা ওবাইদুল হাকিম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা মাজেদ স্যারের গাড়ি চালায়। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তালিকায় নাম কিভাবে এলো জানতে চাইলে হাছনা বলেন, তার পিতা হয়তো নাম দিয়েছেন। তিনি ৫হাজার টাকা পেয়েছেন বলে স্বীকার করলেও তার পিতা ওবাইদুল হাকিম কোন টাকা পাননি বলে জানিয়েছেন। অথচ, তারা পিতা-পুত্রের নামে জনপ্রতি ৫৮ হাজার ৮’শ টাকা করে পেয়েছেন মর্মে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মাজেদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত বিলে সেই পিতা-পুত্রের স্বাক্ষরও রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকের তালিকায় ১০ নং ক্রমিকে নাম রয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি এনজিওর অধীনে কর্মরত পলাশ তালুকদারে। তিনি কোন টাকা পাননি বলে জানিয়েছেন। অথচ মাস্টার রোলে দেখা গেছে, পলাশের নামে ৫৮ হাজার ৮’শ টাকা উত্তোলন করা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মুজিবুর রহমানের স্ত্রীর মালিকানাধীন পেকুয়া বাজারের পূর্বে পার্শ্বে অবস্থিত আন নুর হাসপাতালের ৮জন কর্মচারীর নাম রয়েছে পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোভিড চলাকালীন স্বেচ্ছাসেবকের নামের তালিকায়। এরা হলেন, আন নুর হাসপাতালের কর্মচারী তারিকুল ইসলাম, এক্সেরে টেকনেশিয়ান হোছাইন, কর্মচারী মোস্তাকিম, আয়ুব, নার্স মোকারিমা, নাজরিন সোলতানা নাঈম, শাহানাজ পারভীন, মোজিবুল হক রানার নাম রয়েছে। এরা কেউ পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোভিড ভ্যাকসিনেশন চলাকালীন স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেনি। তারা সেসময় পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসের মুজিবুর রহমানের স্ত্রীর মালিকানাধীন আন নুর হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন।
যার প্রমাণ আন নুর হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই করলে সত্যতা মিলবে। আন নুর হাসপাতালের উক্ত ৮জন কর্মচারীর প্রত্যেকের নামে ৫৮ হাজার ৮’শ টাকা করে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সম্মানী ভাতার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। মাস্টার রোলে তাদের প্রত্যেকের স্বাক্ষরও রয়েছে। তবে আন নুর হাসপাতালে চাকুরীরত থাকায় এ বিষয়ে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে বা অভিযোগ করতে সাহস পাচ্ছেনা বলে কয়েকজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন। তারা জানান, তাদের নামে টাকা লোপাট করা হয়েছে সেটা সত্য। কিন্তু এটি নিয়ে এখন কথা বললে আন নুর হাসপাতাল থেকে চাকুরী চলে যাবে। কারণ আন নুর হাসপাতালের মালিকের স্বামী হচ্ছেন পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবাসিক মেডিকেল অফিসার মুজিবুর রহমান। তাই তারা এ বিষয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।
স্বেচ্ছাসেবক তালিকায় নাম থাকা আন নুর হাসপাতালের কর্মচারী তারিকুল ইসলাম জানান, তাকে মাত্র ১০হাজার টাকা দিয়েছে আরএমও মুজিব স্যার। মাস্টার রোলে ৫৮হাজার ৮’শ টাকা থাকলেও তারিকুল সেই টাকা পায়নি। একই হাসপাতালের কর্মচারী মোজিবুল হক রানাসহ অন্যান্য কর্মচারীদেরকেও ৫হাজার টাকা করে দিয়েছেন আরএমও মুজিব। আরএমও মুজিবের স্ত্রীর মালিকানাধীন হাসপাতালের এক্সেরে টেকনেসিয়ান মো: হোছাইন করোনা ভ্যাকসিনেশন চলাকালে ডিসেম্বর ২০২১ ইংরেজী থেকে জুন ২০২২ ইংরেজী পর্যন্ত পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোন দিন স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেনি। তার নামেও ৫৮হাজার ৮’শ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
এভাবে ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবকের নামে-বেনামে মাস্টার রোল তৈরী করে বরাদ্দের ৮লাখ ৮২হাজার টাকা লোপাটের বিষয়ে বক্তব্য জানতে পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর স্বাস্থ্য ও প:প: কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মাজেদ চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে এ প্রতিবেদককে বলেন, পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত কর্মকর্তা, কর্মচারী, অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মী এবং মাল্টি পারপাস সেচ্ছাসেবকগণের সমস্ত বেতন/অন্যান্য বিল সমুহ তাদের ব্যাংক একাউন্টে সরাসরি প্রদান করা হয়। যাদের ব্যাংক একাউন্ট নেই, তাদের বিশেষ বিবেচনায়, অত্র দপ্তরের হিসাব শাখা হইতে নগদ প্রদান করা হয়।
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমে যারা সেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের কর্ম সম্পাদন রিপোর্ট প্রাপ্তি পরবর্তী বিল প্রদান করা হয়। বিল সমুহ বন্টন নিয়ে অদ্যাবধি কোন স্বাস্থ্য কর্মী/সেচ্ছাসেবক কোন ধরনের অভিযোগ দাখিল করেন নাই। বিল সমুহ বন্টন নিয়ে কোন ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে, তাহা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে।
Discussion about this post