আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ভাগ্যাহত শরণার্থীদের জীবনের দুঃখ-দুর্দশা আর তাদের জীবনে ঔপনিবেশিকতার প্রভাব নিজের লেখনীতে দ্ব্যর্থহীনভাবে ফুটিয়ে তুলে সাহিত্যে চলতি বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তানজানিয়ার ঔপন্যাসিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ।
বৃহস্পতিবার রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি সাহিত্যে ১১৮তম নোবেল বিজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করেছে।
সুইডিশ একাডেমি বলেছে, আব্দুলরাজাক গুরনাহর আপোষহীন ও দরদী লেখায় ঔপনিবেশিকতার দুর্দশা আর শরণার্থীদের জীবনের নানা কষ্ট-ব্যঞ্জনার গল্প ফুটে উঠেছে।
গুরনাহ ১৯৪৮ সালে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জাঞ্জিবার দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। ৬০ এর দশকের শেষের দিকে শরণার্থী হিসেবে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান তিনি।
এখন পর্যন্ত তানজানিয়ার এই লেখক প্যারাডাইস ও ডিজারশনসহ অন্তত ১০টি উপন্যাস এবং কয়েকটি ছোট গল্প লিখেছেন। শরণার্থীদের জীবনের পরতে পরতে যে ব্যঞ্জনা তা পুরোপুরি ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের লেখনীতে। নোবেল পুরস্কারের অর্থ হিসেবে এক কোটি সুইডিশ ক্রোনা পাবেন তানজানিয়ার ৭৩ বছর বয়সী এই লেখক।
১৯৯৪ সালে প্রকাশিত প্যারাডাইস উপন্যাসে ২০ শতকের গোড়ার দিকে তানজানিয়ায় বেড়ে ওঠা এক বালকের গল্প তুলে ধরেছেন আব্দুলরাজাক। এই উপন্যাসই তাকে সাহিত্যের আরেক পুরস্কার ম্যান বুকার এনে দেয় এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে তার অগ্রযাত্রার পথও তৈরি করে দেয়।
বিবৃতিতে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি বলেছে, সত্যের প্রতি আবদুলরাজাক গুরনাহর আত্মোৎসর্গ এবং সরলীকরণের প্রতি তার বিতৃষ্ণা বজ্রাঘাতের মতো। তার উপন্যাস গৎবাঁধা বর্ণনা নয় বরং বিশ্বের অনেক অঞ্চলের কাছে অপরিচিত সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় পূর্ব আফ্রিকার দিকে আমাদের দৃষ্টি উন্মোচন করে দেয়।
তার উপন্যাসের চরিত্রগুলো সংস্কৃতি ও মহাদেশের মধ্যে বিরতি দিয়ে আগের ও উদ্ভূত শরণার্থী জীবনের মধ্যে আটকা পড়ে যায়। উপন্যাসের পরতে পরতে নিজেকে খুঁজে পাওয়া এসব চরিত্রের অনিরাপদ অবস্থার কখনো সমাধানও হয় না।
আব্দুলরাজাক গুরনাহ যুক্তরাজ্যের কেন্টবুরির ইউনিভার্সিটি অব কেন্টের ইংলিশ ও পোস্টকলোনিয়াল সাহিত্যের একজন অধ্যাপক। সম্প্রতি অধ্যাপনা থেকে অবসরে যান তিনি। ১৯৮৬ সালে ওল সোইনকার পর প্রথম আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পেলেন গুরনাহ।
গত বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কবি লুইস গ্লিক, যার দ্ব্যর্থহীন কাব্যভাষা নিরাভরণ ও সৌন্দর্যময় সুস্পষ্ট কাব্যিক ঢং স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে সার্বজনীন করে তোলে বলে জানায় নোবেল কমিটি।
১৯০১ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১৪ বার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে চারবার যৌথভাবে এই পুরস্কার পেয়েছেন দু’জন করে। সাহিত্যের এই নোবেল পেয়েছেন মাত্র ১৬ জন নারী। নোবেল কমিটির সদস্যদের যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনার জেরে ২০১৮ সালে সাহিত্যের পুরস্কার স্থগিত করেছিল সুইডিশ একাডেমি।
পরে ২০১৯ সালে দু’বারের নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। ২০১৮ সালের জন্য পোলিশ লেখক ওলগা টোকারচুক এবং পরের বছরের জন্য অস্ট্রিয়ার পেটার হান্টকরকে সাহিত্যের নোবেল দেওয়া হয়।
করোনা মহামারির কারণে গত বছরের মতো চলতি বছরও নোবেল ফাউন্ডেশন ছোট আকারের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিদিন বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করছে। টেলিভিশন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে এই ফাউন্ডেশন।
বিজয়ীদের প্রাপ্ত পদক ও সনদ পৌঁছে যাবে তারা যেসব দেশের নাগরিক সেসব দেশের কূটনীতিকদের কাছে। বিজয়ীরা নিজেদের দেশের কূটনীতিকদের কাছ থেকে পদক ও সনদ সংগ্রহ করবেন।
প্রতি বছর শান্তি, সাহিত্য, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা ও অর্থনীতি— এই ৬ বিষয়ে যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন তাদের পুরস্কার প্রদান করে সুইডেনভিত্তিক নোবেল ফাউন্ডেশন। আগামী ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ২০২১ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে।
উনবিংশ শতাব্দীতে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল আবিষ্কার করেছিলেন ডিনামাইট নামে ব্যাপক বিধ্বংসী বিস্ফোরক; যা তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পত্তির মালিক করে তোলে। মৃত্যুর আগে তিনি উইল করে যান—প্রতি বছর ৬টি বিষয়ে যারা বিশেষ অবদান রাখবেন তাদের যেন এই অর্থ থেকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯০১ সাল থেকে শুরু হয় নোবেল পুরস্কার ঘোষণা অনুষ্ঠান। গত সোমবার থেকে শুরু হওয়া এই পুরস্কার ঘোষণা অনুষ্ঠান শেষ হবে আগামী ১১ অক্টোবর।
গতকাল সুইডেনের রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস অপ্রতিসম অর্গানোক্যাটালাইসিস বা জৈব-অনুঘটন বিক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য জার্মানির বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন লিস্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড ম্যাকমিলানকে রসায়নের নোবেল বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা দেয়।
তার আগের দিন, মঙ্গলবার বৈশ্বিক জলবায়ুর কাঠামোগত মডেল নির্মাণ, বৈশ্বিক উষ্ণতার পূর্বাভাস ও তা নির্ভুলভাবে পরিমাপের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কার এবং পরমাণু ও গ্রহীয় পরিসরের ভৌত কাঠামো এবং তার ওঠানামার মিথস্ক্রিয়া আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জাপানি বংশোদ্ভূত মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী শুকুরো মানাবে, জার্মানির পদার্থবিজ্ঞানী ক্লাউস হ্যাসেলম্যান ও ইতালীয় পদার্থবিজ্ঞানী জর্জিও পারিসি।
সোমবার (৪ অক্টোবর) চিকিৎসায় নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। চলতি বছর চিকিৎসায় নোবেল পেয়েছেন লেবানিজ বংশোদ্ভূত মার্কিন বিজ্ঞানী আর্ডেম পাতাপুতিয়ান ও মার্কিন বিজ্ঞানী ডেভিড জুলিয়াস। নোবেল পুরস্কারের ১ কোটি সুইডিশ ক্রোনা ভাগাভাগি করে নেবেন এ দুই বিজ্ঞানী।
শুক্রবার শান্তিতে আর আগামী সোমবার (১১ অক্টোবর) অর্থনীতিতে এবারের নোবেল পুরস্কার জয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে।
Discussion about this post