কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ সফরে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল। এ সময় রোহিঙ্গারা প্রতিনিধি দলের কাছে রাখাইন রাজ্যে তাদের ওপর চালানো নিপীড়ন ও নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিয়ে বিভিন্ন দাবি দাওয়ার কথা জানান তারা।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা থেকে বিমানে করে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা কক্সবাজার পৌঁছান।
সেখান থেকে তাদের নেওয়া হয় উখিয়ার মধুরছড়া (ক্যাম্প-৪) আশ্রয়শিবিরে। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন ইইউর মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইয়ামোন গিলমোর। তিনি এ সময় বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে ইইউ চাপ আরও বাড়াবে।
দলে আরও রয়েছেন, ইউরোপিয়ান এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের (ইইএএস) রাজনৈতিক উপদেষ্টা ভিক্টর ভেলেক, ঢাকায় ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলিও ফার্স্ট সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) সেবাস্টিয়ান রিগার-ব্রাউন ও বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবিক কর্মসূচির তত্ত্বাবধানকারী আনা অরল্যান্ডিনি।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিনিধি দলটি ক্যাম্প-৪ ও ক্যাম্প-১৮ আশ্রয়শিবিরে জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর পরিচালিত রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রম, ইউনিসেফ পরিচালিত লার্নিং সেন্টার, রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) পরিচালিত ই-ভাউচার সেন্টার পরিদর্শন করে। বেলা ১টার দিকে ক্যাম্প-৪ আশ্রয়শিবিরে ইউএনএইচসিআরের কমিউনিটি সেন্টারে অন্তত ১৫ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, বৈঠকে রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, সম্পদ লুটের বিবরণ তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়েও কথা ওঠে।
রোহিঙ্গারা সেখানে বলেন, চীনের মধ্যস্থতায় কিছুদিন ধরে পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা চলছে। কিন্তু রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। ফিরে যাওয়ার আগে রোহিঙ্গারা প্রথমে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি চান। তারপর মর্যাদাপূর্ণ, টেকসই ও ইউএনএইচসিআরের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গারা ফিরতে আগ্রহী। আরেকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, বৈঠকে একজন রোহিঙ্গা নারী আশ্রয় শিবিরে দাতাগোষ্ঠীর সাহায্য কমিয়ে আনার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, আগে রোহিঙ্গা পরিবারপ্রতি ১০ ডলার করে দেওয়া হতো। এখন আট ডলার দেওয়া হয়। তা দিয়ে রোহিঙ্গা পরিবারের চলতে কষ্ট হচ্ছে। বৈঠকে আশ্রয়শিবিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর সুরক্ষা, রোহিঙ্গা শিশুর পড়াশোনা, নারী শিশু পাচার নিয়েও কথা ওঠে।
আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা কামাল আহমদ বলেন, সম্প্রতি আশ্রয়শিবিরে খুন-অপহরণ, চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। সাধারণ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আশ্রয় শিবিরগুলোতে বিশেষ সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের কথাও জানানো হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের। সন্ধ্যায় সাড়ে ৬টায় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন, প্রতিনিধি দলের প্রধান ইইউর মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইয়মোন গিলমোর।
তিনি বলেন, এটি বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির এবং এই সময় রোহিঙ্গারা যত বড় সমর্থন পেয়েছে তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ। যে ছয় বছর ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশকে সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। তা অব্যাহত থাকবে।
গত চার বছর বিশ্ববাসী নতুন সংকটে রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, চার বছরে আমরা অনেক সংকট দেখেছি। আফগানিস্তান, আফ্রিকা সংকট, ইউক্রেন পরিস্থিতি তার অন্যতম। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সব সংকট নিয়ে কাজ করছেন।
এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমারের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে জাতিসংঘে এবং মানবাধিকার কাউন্সিলের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তবু মিয়ানমারে পরিস্থিতি পরিবর্তন আনা এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদে এবং মর্যাদায় প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করছেন তারা।
Discussion about this post