বিডি দর্পণ ডেস্ক:
নৌকা ডুবে প্রিয় দুই জনের মৃত্যু হয়েছে ভেবে নিমা শাহ মালয়েশিয়ায় কুলখানির আয়োজন করেছিলেন। এ আয়োজনের কয়েক সপ্তাহ পর তাদের ফিরে পান তিনি। তবে মালয়েশিয়ায় নয়, তাদের খোঁজ মেলে পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্দোনেশিয়ায়।
ভেবেছিলেন স্ত্রী-কন্যা মারা গেছে মাঝসমুদ্রে। তাদের মরদেহ পাওয়ার আশা নেই; হয়ে গেছে কুলখানি। কিন্তু ঘটনাক্রমে পরিবারের মৃত ভেবে নেয়া সদস্যদের সঙ্গেই পুনর্মিলন হলো রোহিঙ্গা যুবক নিমা শাহর (২৪)।
বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়, নিমা শাহ থাকতেন মালয়েশিয়ায়। তিনি চেয়েছিলেন পরিবারকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে।
বাংলাদেশের কক্সবাজার ক্যাম্প থেকে স্বামীর কাছে যেতে ছয় বছরের সঞ্চয় ভেঙে চোরাচালানকারীদের রাজি করিয়েছিলেন নিমার স্ত্রী মাজুমা। সমুদ্রপথে আরও শখানেক রোহিঙ্গার সঙ্গে ছোট্ট নৌকায় রওনা হন মালয়েশিয়ার উদ্দেশে।
সে যাত্রা শুরুর পর প্রতীক্ষার প্রহর বাড়তে থাকে নিমার। সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যায়। দেখা মেলে না স্ত্রী মাজুমা আর ছয় বছরের শিশু সন্তান ফাতেমার। আশা হারিয়ে ফেলেন নিমা। কিন্তু ভাগ্য তার প্রসন্ন।
নৌকা ডুবে প্রিয় দুই জনের মৃত্যু হয়েছে ভেবে তিনি মালয়েশিয়ায় কুলখানির আয়োজন করেছিলেন। এ আয়োজনের কয়েক সপ্তাহ পর তাদের ফিরে পান তিনি। তবে মালয়েশিয়ায় নয়, তাদের খোঁজ মেলে পার্শ্ববর্তী দেশে।
ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে আসা রোহিঙ্গাবোঝাই একটি নৌকার ভিডিওতে নিজের স্ত্রী-কন্যাকে আবিষ্কার করেন নিমা।
ইন্দোনেশিয়ার উপকূলবর্তী শহর লোকসুমাওয়েতে স্থানীয়রা নৌকাটিকে উপকূলে টেনে আনেন।
এ বিষয়ে নিমা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, পরিবার হারানোর বেদনা যখন খুব পীড়া দিচ্ছিল, তখন রোহিঙ্গাবাহী নৌকায় তাদের ফিরে পাওয়ার ঘটনা তাকে বাকরুদ্ধ করে দেয়।
শাহ বলেন, ‘স্ত্রী-কন্যাকে চিনতে পারার মুহূর্তটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির সময়।’ নিমা শাহ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে মালয়েশিয়া থাকতেন। তিনি দিনমজুরের কাজ করে মাসে ৫০০ ডলার (প্রায় ৪০ হাজার টাকা) উপার্জন করতেন।
রোহিঙ্গা নৌকার ইন্দোনেশিয়া আগমনের খবর পাওয়ার পর অনলাইনে সে ভিডিও দেখেন নিমা। তারপর নিজেদের পরিচিতদের মাধ্যমে স্ত্রী মাজুমার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন তিনি।
মাত্র কয়েক মিনিটের ফোন কলের পরই নিমা মালয়েশিয়ার চাকরি ছেড়ে দেন। দ্রুত ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কয়েক মাস পর তার সঙ্গে স্ত্রী মাজুমা ও ছয় বছরের মেয়ে ফাতেমার দেখা হয়।
বর্তমানে লোকসুমাওয়েতে শরণার্থীদের জন্য সাবেক স্কুল ঘরে বানানো ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে নিমা ও তার পরিবার।
মিয়ানমারে কয়েক যুগ ধরে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে রোহিঙ্গারা। দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রপথে তাদের পাচার করা হচ্ছে।
নিমা জানান, তিনি ছয় বছর আগে স্ত্রী ও সদ্যোজাত মেয়েকন্যাকে মিয়ানমারে রেখে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়েশিয়ায় যান। নিমার স্ত্রী-কন্যাও দ্রুত মিয়ানমার ছেড়ে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের কক্সবাজার ক্যাম্পে চলে আসেন।
নিমার স্ত্রী মাজুমা মালয়েশিয়া যেতে দীর্ঘদিনের সঞ্চয় থেকে টাকা দিয়ে চোরাচালানকারীদের রাজি করান। চোরাচালানকারীরা তাদের কথা দেয় মালয়েশিয়ার চার হাজার কিলোমিটারের সমুদ্রপথ মাত্র এক সপ্তাহে পাড়ি দেবে। কিন্তু বাস্তবে এ যাত্রায় লাগতে পারে কয়েক মাস। সে যাত্রা হতে পারে বিভীষিকাময়।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, এ বছর দুই শতাধিক রোহিঙ্গা পাচারকারীদের মারধরে কিংবা অভুক্ত অবস্থায় মারা গেছে।
এএফপির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মাজুমা ও ফাতেমা মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ফেব্রুয়ারিতে রওনা দেন। কিন্তু নিমা শাহ তাদের কোনো খবর না পেয়ে এক পর্যায়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
‘আমি নিজে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর বিয়ে করব না এবং আজীবন তাদের মনে রাখব’, বলেন নিমা।
লোকসুমাওয়ের শরণার্থী শিবিরে শত শত রোহিঙ্গা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে। শিবির থেকে অন্য কোথাও যেতে পারছে না নিমা ও তার পরিবারের সদস্যরা। মালয়েশিয়ার জীবনের জন্য আক্ষেপ আছে নিমার মনে।
তিনি জানান, মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে মালয়েশিয়ায় যাপন করা স্বাধীনতা ইন্দোনেশিয়ায় নেই বলে। কিন্তু আক্ষেপ কেটে যায় ফিরে পাওয়া পরিবারের কথা ভেবে।
‘আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের আমি ফিরে পেয়েছি; এখন আমরা আবার একসঙ্গে’, বলেন নিমা।
Discussion about this post