তৃণমূলে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের (পিআইও) বিরুদ্ধে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ফলে টিআর, কাবিখা ও কাবিটার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশে পিআইওদের অনেকে এসব অনিয়ম করছেন। কেউ কেউ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে অগ্রিম টাকাও ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সচিত্র প্রমাণসহ অভিযোগ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরে জমা পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ত্রাণ অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। বদলি ও শাস্তি দেওয়া হয়েছে কয়েকজনকে। কিন্তু প্রভাবশালীদের সঙ্গে তাদের বিশেষ সখ্য থাকায় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টিও ধামাচাপা পড়ে যায়। এ ছাড়া অনেকের ফাইলই চাপা পড়ে থাকে জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় বদলি করা হলেও অনেকে সেখানে যোগদান না করে তদবিরের মাধ্যমে বদলি স্থগিত করান। এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে সত্যতাও মিলেছে। আত্মসাতের টাকা জমা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এরপরও তারা অপ্রতিরোধ্য।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বিভিন্ন উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ তার দপ্তরে আসছে। এ বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কেউ অনিয়ম ও দুর্নীতি করে পার পাবে না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম ২০১৭-১৮ সালের টিআর কর্মসূচির আওতায় তিনটি অস্তিত্ববিহীন প্রকল্পের বিল ভাউচার তৈরি করে কমিটির যোগসাজশে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬০৮ টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে এ বিষয়ে দুদকের তদন্তে সত্যতা মেলায় তিনি সেই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে দেন। এরপর তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮-এর ৩ (খ) ও (গ) ধারায় বিভাগীয় মামলা করা হয়। তার তিন বছরের বর্ধিত বেতন কর্তন করেছে মন্ত্রণালয়। বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম নিজেও স্বীকার করেন যে, তিনি প্রকল্প পরিদর্শন না করেই বিল ভাউচার করেছিলেন। সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আমিনুল হক স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তার তিন বছরের বর্ধিত বেতন কর্তন করা হয়। এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম বলেন, এটা ভুলবশত হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প হয়ে আসে। এর মধ্যে দুটি ডাবল প্রকল্প ছিল। না দেখার কারণে এমনটি হয়েছে।
অনিয়ম-দুর্নীতি ও অসদাচরণসহ নানা অনিয়মে অভিযুক্ত গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নুরুন্নবী সরকারকে বরখাস্ত করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। এর আগে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে নুরুন্নবী সরকারকে বান্দরবান সদর উপজেলায় বদলি করা হয়। কিন্তু বান্দরবানে যোগদান না করায় তাকে প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্তির আদেশ দেওয়া হয়। এরপরও প্রধান কার্যালয়ে যোগদান করেননি নুরুন্নবী সরকার। ২০১৫ সালে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় যোগদানের পর থেকে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ঘুষ-দুর্নীতির দায়ে তার বিরুদ্ধে দুদকসহ বিভাগীয় পাঁচটি মামলা হয়।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কমিশন বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। উপজেলা পরিষদের সমন্বয় কমিটির সভায় এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার ঘটনাও ঘটে। সভায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) বিচারসহ প্রত্যাহারের দাবি করেন। এর আগে ওই উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টির চেয়ারম্যানরা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন পিআইওর বিরুদ্ধে। তারা জানান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাইদুল ইসলাম এ উপজেলায় যোগদানের পর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সমন্বয় না করে নামমাত্র ত্রাণ বিতরণ করে বাকি সব তিনি নিজেই আত্মসাৎ করেন। ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে কাজ না করে বিল উত্তোলনও করেন তিনি। এ ছাড়া টিআর, কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পগুলোতে ২০ শতাংশ কমিশন শর্তে বিলে স্বাক্ষর করে থাকেন এই পিআইওÑ এমন অভিযোগও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের। পিআইও মাইদুল ইসলামের কারণে টিআর, কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের ভাগাভাগি নিয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সঙ্গে দুই ভাইস চেয়ারম্যানের পাল্টাপাল্টি হামলা ও মামলার ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) অফিসে অনিয়ম, দুর্নীতি অব্যাহত রয়েছে। প্রতিটি প্রকল্প থেকে মানুষের কাছ থেকে দুই-তিন হাজার টাকা আদায় করার অভিযোগ ওঠেছে। এ টাকা সংগ্রহ করে থাকেন পিআইও অফিসের অফিস সহায়ক জীবন চন্দ্র দাস। কেউ ঘুষের টাকা দিতে না চাইলে তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। দীর্ঘদিন প্রকল্প কর্মকর্তার অফিসে ঘুষবাণিজ্য চালালেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। চলতি অর্থবছরে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুকূলে ৩১৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসবের কথা বলে কয়েক লাখ টাকা টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)-এর অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে বানিয়াচং পিআইও অফিস ঘুষ-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এস এম এ করিমকে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এ বরখাস্তের আদেশ দেয়। অধিদপ্তরে উপপরিচালক (উপসচিব) লুৎফুন নাহার স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, ‘২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোহাগড়া উপজেলার সেতু নির্মাণ খাতের ১৬টি প্রকল্পের শিডিউল বিক্রির সংখ্যা কম দেখিয়ে পিআইও এস এম এ করিম ৭ লাখ ৫১ হাজার ৫০০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে তিনি সবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন।’
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির ২ কোটি ৩০ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯৯ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দুদক বগুড়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বাদী হয়ে দুদক আইনে এই মামলা করেন। এতে পিআইও আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে কাজ না করেই ২৯৫টি ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে ২ কোটি ৩০ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯৯ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, টিআর, কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন না করে ভাগাভাগির ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। অনেক জেলা বা উপজেলায় প্রকল্পের কাজ না করে টাকা তুলে নিয়েছেন এমন শত শত অভিযোগ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে রয়েছে। অথচ এসব অভিযোগের কোনো তদন্ত হচ্ছে না। ফলে তারা আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগসাজশ, অন্যদিকে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিশেষ সিন্ডিকেট তাদের রক্ষা করার জন্য দীর্ঘ সময় ফাইল চাপা দিয়ে রাখছে।
Discussion about this post