মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালু রাখা জরুরী-বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বিডি দর্পণ ডেস্ক:
করোনাভাইরাসের প্রকোপে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়েছে। মৃত্যুভয়, আর্থিক সংকট, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে প্রায় সব মানুষই চিন্তিত। নতুন রোগ সম্পর্কে অজ্ঞাত আতঙ্ক, লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বৃদ্ধি, বেকারত্ব, ব্যবসায় ক্ষতিসহ নানা সামাজিক সংকটের কারণে বাড়ছে মানসিক সমস্যা।
মানসিক সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে দেশের মানুষের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার হারও বেড়েছে।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের কোভিড-১৯ ফোকাল ডা. ইয়াসির আরাফাত জানিয়েছেন, করোনা পরবর্তী সময়ে বিশেষত আক্রান্ত হওয়ার দুই মাস পর থেকে আক্রান্তদের ৪০ শতাংশই মানসিক বিষন্নতায় ভোগেন, দুঃশ্চিন্তায় ভোগেন ৪০ শতাংশ, স্ট্রেস বা মানসিক চাপে ভোগেন ৩০ শতাংশ। এছাড়াও ঘুমের সমস্যায় ভোগেন ৫০ শতাংশ। এমন অবস্থায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা জরুরী।
তিনি বলেন, এখানে দুইটি জিনিস ঘটে। প্রথমে যখন কোভিড হয় তখন এনজাইটি ডিসঅর্ডার চলে আসে। সে ভয় পেয়ে যায়। যাদের সিভিয়ার কোভিড হয়, যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়, ন্যাজাল ক্যানোলা লাগে, এইচিডিইউতে আইসিইউতে থাকে তারা যখন ছাড়া পায় তখন তাদের মধ্যে একটা মানসিক দুঃশ্চিন্তা কাজ করে। শরীরটা ভালো লাগে না। সে ভয় পায়।
এমন পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা প্রথম থেকেই জরুরী। সুস্থ হওয়ার পরও একজন চিকিৎসকের ফলোআপে থাকা দরকার। চিকিৎসক তার সাথে কথা বলে বুঝতে পারবেন, তার মানসিক অবস্থানটা কি এবং সে অনুযায়ী তাকে পরবর্তীতে ব্যবস্থা দিতে পারবেন। ডা. ইয়াসির আরাফাত বলেন, আমরা এমনও দেখেছি, ৩ মাস বা তার বেশি সময় আগে তার যে করোনা হয়েছিল সেটা নিয়ে সে এখনও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত। সে তা ভুলতে পারে না। তখন চিকিৎসা এবং সাইকোথেরাপী দুটোই তার প্রয়োজন। তারা স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে দেরি হয়। আমরা নিয়মিত এ ধরনের রোগী পাই। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চীপ সাইকোলজিস্ট তারেকুল ইসলাম বলেন, করোনার ভয়ঙ্কর থাবায় নাকাল কক্সবাজার জেলা।
মিয়ানমার, বান্দরবন এবং চট্টগ্রাম জেলা বেষ্টিত বাংলাদেশে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের জেলা কক্সবাজার জেলা রয়েছে চরম ঝুকিঁতে।
এছাড়া প্রায় সাড়ে এগার লাখ রোহিঙ্গার অবস্থান এই আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। করোনার প্রভাবে মৃত্যু, বেকারত্ব, কর্মহীনতা, শিক্ষা ও ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত কক্সবাজার জেলার মানুষ ভুগছে বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় যেদিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘দেশে এখনো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়টি উপেক্ষিত। বাংলাদেশের মোট বাজেটের.০৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকে মানসিক স্বাস্থ্যখাতে যেটা একেবারেই অপ্রতুল। অথচ এই ভয়ঙ্কর করোনার কারণে সৃষ্ট মানসিক সমস্যাগুলোকে গুরুত্বের সাথে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘ লকডাউন, করোনার ভয়, চাকরি হারানো, বেতন কমে যাওয়া, পরিবার বা পাড়াপড়শির আক্রান্ত হওয়া, সামাজিক দূরত্ব, চার দেওয়ালের মধ্যে মূলত নিজেকে বন্দি রাখার প্রভাব এখন ভালোভাবেই পড়ছে সাধারণ মানুষের মনের ওপর। তাঁরা অবসাদগ্রস্ত হচ্ছেন। দুশ্চিন্তা ভয়ঙ্করভাবে বাড়ছে।
দেখা দিচ্ছে উদ্বেগ সহ মানসিক নানা ধরনের সমস্যা। আর অজ্ঞানতার জন্য হোক বা অস্বস্তি বোধ করার কারণে হোক, লোকে এই মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলেন না। নিজের মধ্যে রাখার চেষ্টা করেন। ফলে সমস্যা আরও বাড়ে।’
এদিকে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক সহায়তামূলক কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য এনজিও বিষয়ক ব্যুরোকে সুপারিশ করেছে শরনার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়। এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে এর প্রভাব অত্যন্ত নেচিবাচক হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র সাইকোলজিস্ট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে অনেক বেসরকারী সংস্থার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে কক্সবাজার জেলার হাজারো যুবক বেকারত্বের গ্লানি বহন করছে। এর উপর মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক সহায়তামূলক কার্যক্রম, প্রটেকশন কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য যে সুপারিশ করা হয়েছে করা হয়েছে তা যদি বাস্তবায়িত হলে আরো অনেক যুবক বেকার হয়ে পড়বে।
ফলে উখিয়া ও টেকনাফে উগ্র মনোভাব ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে বাস করা রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যেও করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে৷ সম্প্রতি তারা করোনা মহামারীর কবলে পড়ে মানসিক ভাবে আরও ভেঙ্গে পড়েছে। তারা মহামারীর কারণে বিভিন্ন নির্যাতনের হারও বেড়ে যাচ্ছে।
এমন অবস্থায় সকল সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট জোরদার করা দরকার। যাতে করোনা কালীন অবস্থায় সকলেই সামান্য হলেও স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপনের চেষ্টা করতে পারে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের আগমনের ফলে দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধগতি, পরিবেশগত সমস্যাসহ নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হয়ে উখিয়া এবং টেকনাফ অঞ্চলের মানুষরা নানামুখী মানসিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ‘কোভিড পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সংকুচিত বা বন্ধ করা হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা’-এমন প্রশ্নের জবাবে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের কোভিড-১৯ ফোকাল ডা. ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘এই মহামারিকালে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সব জায়গায় জরুরি। রোহিঙ্গারা যখন কক্সবাজার সদর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে চলে যায় তখন ক্যাম্পে যারা সাইকোলজিস্ট আছে সেখানে যায়। খুব বেশি সমস্যাা না হলে আর আসে না।
আমি জানি, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার অধিনে সেখানে সাইকোলজিস্ট আছে। তারা নিয়মিত সেবা দেয়। সাইকোলজিস্টদের কাছে খুব বেশি যেতে হয় এমনও না। কিন্তু এ অবস্থায়, এই কোভিড পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সংকুচিত করা কোন অবস্থাতেই উচিত হবে না। সংকোচিত করা হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
Discussion about this post