সংগ্রহ ও ভুমিকা কালাম আজাদ:
আজ আমি এমন একটি চিঠির কথা উল্লেখ করবো যে চিঠিটা চট্টগ্রাম শিক্ষা কলেজ ছাত্রী সাহানা তার সহপাঠী সন্তোষদার (যাকে আমরা পরবর্তীতে কবি সম্পাদক অমিত চৌধুরী হিসেবে চিনি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী কক্সবাজার দখলে নিলে প্রফেসর মোশতাক আহমদ, তৎকালিন এম এন এ নুর আহমদ, এমপিএ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, বাদশা মিয়া চৌধুরী, একেএম মোজাম্মেল হকসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বার্মায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন) কাছে লিখছেন। ১৯৭১ সালের ১৫ অক্টোবর লিখিত এ চিঠিতে সাহানা।
১৫ অক্টোবর ‘৭১-এ লেখা এ চিঠিতে বন্ধুকে কাছে না পাওয়ার বেদনা, যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতি, লুকিয়ে লুকিয়ে জীবনযাপন, শরণার্থী হিসেবে ভারত ও বার্মায় আশ্রয় গ্রহণ, দালালের নমুনা, নিজেকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দাবি করে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচারে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে বাধ্য হওয়া, শরণার্থী হওয়ার যন্ত্রণাসহ বিভিন্ন বিষয় আসয় উঠে এসেছে।
এ চিঠিটি ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে কবি অমিত চৌধুরীর কক্সবাজারস্থ বাসার দু তলার কাজ করার সময় মালপত্র ঠিক করতে গিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকাবস্থায় পেয়ে নিজের করায়ত্ব করি, তারপর আমার চাউলবাজারস্থ বাসায় চলে যাই, পরে রাত্রে শূন্য দশকের কবি, কক্সবাজার জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সহ সভাপতি মাসউদ শাফি (২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রয়াত হয়েছেন) কে দেখাতে গিয়ে কস্টপ নিয়ে ছেড়াচিঠিগুলো বেধে দেয়।
উনি বললেন, তুমি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে কাজ করো, তাই তোমার কাজে লাগবে।’’ তার কথামতে আমি রেখেও দিয়েছিলাম। পরে অমিত চৌধুরীকে দেখাতে তিনি বললেন, তুরা দু চুকরা আমাকে কী ষড়যন্ত্র করবি কে জানে…মুসলমান ও হিন্দুর প্রেমের কথা বলবি এই তো!। ’ আমি ও মাসউদ বললাম একাত্তরের চিঠি বলে কথা। এখানে অনেক তথ্য রয়েছে….। তিনি সাহানা সম্পর্কে বিস্তারিত বললেন।
আমাদেরকে ২০০টাকা দিয়ে বললো, রেখে দাও…কাজেও লাগতে পারে।,,,পরে আমার কাছে থাকা অবস্থায় একদিন হারিয়ে গেছিলো…পরে আমার বান্ধবী আসমা বর্ষার পানিতে শুকাতে হাত পুড়িয়ে ফেলেছিলেন..তাকে ধন্যবাদ )। ঠিঠিটি ১৫ জানুয়ারি ফেইসবুকে দেওয়ার পর জানতে পারি ওই চিঠি লেখক সাহানা এখনো বে৭চে আছেন। এখন ঢাকার একটি স্বনামধন্য স্কুল এন্ড কলেজে ( ওই স্কুল এন্ড কলেজটি দেশ সেরা হন সব সময়) পড়ায়।

অনুজপ্রতীম সৌরভ দেব (কক্সবাজার জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি) অনুরোধে চিঠিটির পাঠোদ্ধার করে হুবহু নিম্নে প্রদান করা হলো:
পনরো দিন, অক্টোবর, একাত্তর
‘জাকিরা মঞ্জিল’ ৬০৫/খ, মেহেদীবাগ রোড চাটগাঁ।
সন্তোষদা,
উহ্. কি দিয়ে আরম্ভ কোরবো বল? চিঠিতে তোমাকে ডেকে শান্তি পাচ্ছি না। দাদা, দাদা কোরে ডেকে গলা ফাটিয়ে চীৎকার কোরতে ইচ্ছে কোরছে। এখনও তোমার ঠিকানা হাতে আসেনি। কলেজে গিয়েছিলাম আজ। স্যার ও দিল্ মোহাম্মদের কাছে লিখা তোমার চিঠি পড়লাম। চিঠিগুলো ওঁদের দিতে ইচ্ছে হয়নি।
ইচ্ছে কোরেছিলো ওঁদের কাছ থেকে চেয়ে নিই। কিন্তু এসব হয়তো ওঁদের কাছে প্রগল্ভতা মনে হবে, তাই পারিনি। দাদা, কবে তোমাকে দেখবো? বিশ্বেস করো, প্রত্যেকটা রাতে তোমাকে স্বপ্ন দেখি। কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেলি। যখনই একলা বসে ভাবি কেঁদে পার পাই না দাদা। আন্দাজ কোরেছিলাম, তুমি বার্মাতেই আছ। তোমার জন্যে যখন মনটা বেশী খারাপ লাগতো। তখন পাতার পর পাতা তোমাকে লিখতাম, কাঁদতাম কতক্ষণ। তারপর বিফল কাঁদার নিশ্বাসে বিষময় হোয়ে উঠতো ঘরের বাতাস। টুকরো টুকরো কোরে ছিড়ে ফেলতাম কাগজগুলো, যেনো আমার হৃদয়তন্ত্রীর একেকটা তার টেনে ছিঁড়ে ফেল্ছি।
কতরাতে তোমাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরেছি ‘দাদা’ বোলে। জিজ্ঞেস কোরেছি, সত্যি কোরে বল দাদা আমাকে ফেলে যাবি না? তুমি আমার মাথায় হাত রেখে বলেছো, নারে সানু, এবার আর যাবই না তোকে ফেলে। তোমার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে গিয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। মনে হোয়েছে, ঘুমটা ভাঙ্লো কেনো, স্বপ্নেও তো তবু পেয়েছিলাম তোমাকে। দাদা আমি পারছি না এসব ভাবতে। উহ্, এত নিষ্ঠুর তুই কেমন কেমন কোরে আছিস্ আমাকে ফেলে? দাদা আজ তোমার খবর পেয়ে বাঁধভাঙা কান্নার ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে অশান্ত মনের বালুচরটাতে।
তুমি আমাকে একটা চিঠি লিখলে না কেন এতদিন? যখন প্রথম চিঠিপত্র বিলি আরম্ভ হোয়েছিলো, তখনই কক্সবাজারের ঠিকানায় (পাবে না জেনেও মনকে প্রবোধ দিতে) লিখেছি। বেঁচে থাকার এডভেঞ্চার কি শুনবে? এরচে’ লক্ষ গুণ বেশী অভিজ্ঞতা তোমাদের হোয়েছে। সে হিসেবে শরীরের আঁচড়টি লাগেনি আমাদের। যাক্ পালিয়ে পালিয়ে বেঁচে আছি। হ্যাঁ, দাদা, চিন্তা কোরোনা, ভালোও আছি আল্লাহর রহমতে। তোমার ও করিদার জন্য শাস্তি পাচ্ছি এখনও। পাঁজী মনটা বুঝতে চায় না সব কথা। করিদা নাকি চিঠি পাঠিয়েছিলেন।
আমার অবশ্যি সৌভাগ্য হয়নি তাঁর চিঠি দেখার। অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন এটুকু শুনেছি। রিনু, লিলি, স্বপ্না এরা ওপার বাঙলায়। রওশন, কুসুম বাড়ীতে, এর চেয়ে বেশী ওঁদের খবর জানি না। বেবি এখন নাজিরহাট (উদালিয়া চা বাগানে)। শাহীন, মন্ডা, শামসুন, সেলিনা, রুবী, ভাবী এরা সবাই ভালো আছে। দাদা, বিশ্বাসঘাতকের দল, চরম স্বার্থবাদী আমরা পরীক্ষা দিয়েছি। ক্ষমা কোরতে পারবে না জানি। তুমি কেনো, আমি নিজেও আমাকে ক্ষমা কোরতে পারি না, পারবো না।
বিবেকের অন্তর যাবে কোথায় বলো? ছেলেদের মধ্যে যাঁদের খবর জানি, প্রায় ত্রিশজনের মতো (কম বেশী হোতে পারে) পরীক্ষা দিয়েছেন। শামসুল আলম, বেহাইন, জব্বার, ইদ্রিস, জামিল, নাজিমুদ্দীন, সরওয়ার, ইকবাল, নেসার, দিবাস্বপ্ন, ইসহাক, মিলন, রাখাল, তাল্ত ভাই, রাজ্জাক ভাই, বড়দা, সুফিয়ান, কাসেম, কাঁদর কিল্লাই, তালেব, আবু তাহের। কে বোল্লে আমি এত বোকা? (নাম ভুলে গিয়েছি) রাখাল ( সবার কথা খেয়াল নেই আমার) এঁদের সাথে দেখা হোয়েছে। এ চিঠি তোমার কাছে পৌঁছবে বোলে বিশ্বাস হচ্ছে না মনে। কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হোচ্ছে। তোমার কাচে পাঠিয়ে চাতকের মতো হা কোরে বসে থাকবো উত্তরের অপেক্ষায়।
তোমার আগের লেখা চিঠিগুলো পড়ে মনটা গুমরে উঠে, দলে-পিষে একাকার হোয়ে যায় ক্ষত-বিক্ষত মনটা। পেয়ে হারানোর ব্যথা যে কত মারাত্মক তা’ বুঝি এখন। কেনই বা তোমার সাথে পরিচয় হোয়ে এত ঘনিষ্ঠতা হোলো, আর যদিই বা হোলো-ভগবান আজ একটু সাত্ত্বনা কেন দিচ্ছেন না, সহ্য শক্তি কেন দান কোরছেন না?
মার্চের আঠারোতে তোমার সাথে শেষ দেখা। জানি, সেদিন লিলি, রিনুর সাথে দেখা কোরতে গিয়েছিলাম ওদের না পেয়ে মনটা বড় খারাপ হোয়ে যাওয়ায় বাসায় ফিরতে ইচ্ছে হোলো না। রুবাদের বাসায় যাব বোলে ইউসুফকে এ পতে এনে তোমার সাথে দেখা কোরেছিলাম। তাই, দেখতে এসেছিলাম। এসে দেখলাম, মাথা Wash করিয়েছ।
আর এই যে তোমার সাথে শেষ দেখা হবে তা’ যদি বুঝতে পারতাম তবে তোমার পা’র ধূলো মাথায় নিয়ে আসতাম। অনেক সময় বুঝে না বুঝে কত দুঃখ দিয়েছি তোমাকে, না, দাদা, দোহাই তোমার ভুলেও যেয়োনা; ক্ষমাও কোরো না। জানো, লিখছি তোমাকে, আর উদাস হোয়ে যাচ্ছি। কি জানি চিঠি পাবে কিনা। দাদা, কত কথা ভেসে উঠ্ছে আরো। কলেজের বারান্দায়, পেছনে, ক্লাসে, হোস্টেলে তোমার সাতে মান-অভিমানের কত স্মৃতি।
তুমি ডেকেছিলে, ‘এই পাগ্লী শোন এত ঝামেলার মধ্যে আমাকে টানিস্ কেনো? ’ বারে, তোমাকে ঝামেলায় ফেলে কষ্ট দেবো না তো তবে কাকে দেব? তোমাকে দিস্তা ভর্ত্তি কাগজে লিখতে ইচ্ছে কোরছে। এতদিনের জমানো কথা, লুকানো ব্যথা সব কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে। তুমি চিঠি পারে কিনা কে জানে? দাদা, তোমার লেখা একটা লাইনের চিঠি পেলেও আমি যে কি করব ভাবতে পারছিনা।
দিদি, বৌদি, দাদা আর তাঁদের ছেলেমেয়েরা কে কোথায় কেমন আছেন জানিও। তুমি কেমন আছ? তোমার অবস্থা বিস্তারিত লিখবে, তবে অনেকটা শান্তি পাব। কি অবস্থায় আছ জানিও। খাওয়া-পরা কিভাবে চল্ছে লিখো কেমন?
দাদা, চিঠিতে তোমাকে পেয়ে ছাড়তে ইচ্ছে হোচ্ছে না। দাদা বোল্তে পারিস কি কবে দেখা হবে? আমি যেনো একটা মুহূর্তও সহ্য কোরতে পারছি না। দাদা, আজ যদি তোকে এ দুটো হাতে সেবা করতে পারতাম, তবে আমার বুক ভরে উঠতো মহানন্দে। চিঠি পাবে নাকি তুমি? তোমার চিঠি পেলে আবার লিখবো, কেমন?
উহ্! রিনু, লিলি, কমল, তুমি তোমরা আমাকে বেশী কষ্ট দিচ্ছ। তোমাদেরকে স্বপ্ন দেখে কেঁদে কেঁদে অস্থির হোয়ে পড়ি। আর কত দিন অপেক্ষা কোরতে হবে, তোমাদের জন্যে?
তুমি আমাকে এই ঠিকানায় লিখবে-
নাজমুন নাহার মন্ডা (সাহানা)
প্রযত্নে/আলহাজ্ব মোঃ আবু জাফর
৪১৮/এ, মোগলটুলী, চাটগাঁ
আমি এখন মেহেদীবাগে আছি। তবে খুব শীগ্গীরই হয়তো সবে যাবো। অথবা, আব্বার অফিসের ঠিকানায় দিও-সাহানা, প্রযত্মে/ মোহাম্মদ জাহিদ আলী, সাবহেড (Sub-Head), টি.এ ব্রাঞ্চ (T A Branch) পি, ই, রেলওয়ে, পলোগ্রাউন্ড, চাটগাঁ।
ভালো থেকো। ভালোবাসা জেনো।
তোমার সানু
১৫ই অক্টোবর, ‘একাত্তর।
Discussion about this post