এস.এম. আব্দুর রহমান সেলিম-
আজকাল ধর্ষণের পাশাপাশি বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ শব্দটাও লোক মূখে বলতে শোনা যায়। এটা নিয়ে যে মামলা হচ্ছেনা তা নয়। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে, কোন আইনের আলোকে মামলা হচ্ছে তা জানা জরুরি। বিভিন্ন আইনের ব্যাখ্যা এবং আইনি নজিরের মাধ্যমে তা আলোচনা করার চেষ্টা করব। বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ সম্পর্কে জানতে হলে, প্রথমে জানতে হবে ধর্ষণ কি?
ধর্ষণ:
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ ধর্ষণের সাজা কি হবে তা নিয়ে আলোচনা করলেও, ধর্ষণ কাকে বলে জানতে আমাদের দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ৩৭৫ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ধারা ৯ এক সাথে বিশ্লেষন করতে হবে। দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুসারে ৫ টি ঘটনা ঘটলেই আমরা ধর্ষণ বলতে পারি।
১। স্ত্রীলোকটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে। অথবা
২। স্ত্রীলোকটির সম্মতি ব্যতিত। অথবা
৩। স্ত্রীলোকটিকে ভয় প্রদর্শন করে। অথবা
৪। স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমে, যেক্ষেত্রে পুরুষটি জানে যে সে স্ত্রীলোকটির স্বামী নয় এবং স্ত্রীলোকটি পুরুষটির সাথে তার আইন সম্মত ভাবে বিয়ে হয়েছে বলে বিশ্বাস করে। অথবা
৫। স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমে অথবা সম্মতি ব্যতিত যেক্ষেত্রে স্ত্রীলোকটির বয়ষ ১৪ বছরের কম, যৌনসঙ্গম সংগঠিত হলে থাকে ধর্ষণ বলতে পারি। অপর দিকে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন,২০০০ এর ৯ ধারার ব্যাখ্যাতে ধর্ষণের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
এখানে বলা হয়েছে, কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন করে বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে যৌনসঙ্গম করলে ধর্ষণ হবে।
এখানে আরো বলা হয়েছে, কোন পুরুষ যদি বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিত যৌনসঙ্গম করে, তাহলে সেটাও ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। উপরে উল্লেখিত আলোচনাতে আমরা ৩ টা বিষয় সম্পর্কে ধারনা পাই-
১। সম্মতি: কোন নারীর সম্মতি ব্যতিত এবং ভয় প্রদর্শন করে যৌনসঙ্গম করলে ধর্ষণ বলে গন্য হবে।
২।বয়স: কোন নারী যার বয়স ১৪ অথবা ১৬ বছরের নিচে সম্মতি ব্যতিত বা সম্মতিসহ যৌনসঙ্গম করলে ধর্ষণ বলে গন্য হবে। তবে ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সম্মতি নিয়ে যৌনসঙ্গম করলে ধর্ষণ বলে গন্য হবে না।
৩। প্রতারণা: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯ ধারায় “প্রতারণামূলকভাবে” শব্দটি ব্যবহার করলেও উক্ত আইনে এর সংজ্ঞা প্রধান করা হয়নি। তাই “প্রতারণামূলকভাবে” বলতে কি বুঝাবে? কিভাবেই বা এই শব্দটা আদালতে প্রমান করবে তা বর্তমানে আইনের এক জটিল প্রশ্ন!
বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ! আইন কার পক্ষে?
বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ বলতে আইনে যেমন কোন ধারা নেই,টিক তেমনি প্রলোভন শব্দটি প্রমাণ করাও কঠিন। তবে দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ৪৯৩ মাধ্যমে উক্ত মামলা করা হয়ে থাকে। ধারা ৪৯৩ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে প্রতারণামূলকভাবে আইন সম্মত বিবাহিত বলে বিশ্বাস করান, কিন্তু আদৌ ওই বিয়ে আইনসম্মতভাবে না হয় এবং ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, তবে উক্ত ব্যক্তি একজন অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে এবং ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
তবে এটা কোনভাবেই ধর্ষণ বলা যাবে না। কারন ধর্ষণ হতে হলে কিছু বিষয় অব্যশই প্রমান করতে হবে যা দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ৩৭৫ বলা হয়েছে। দন্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এক সাথে আলোচনা করে বলতে পারি, ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সম্মতি নিয়ে যৌনসঙ্গম করলে ধর্ষণ বলে গন্য হবে না। তাই সম্মতি যেখানে প্রমাণিত সেখানে ধর্ষণ অপ্রসাংগিক।
এখন দেখব আইনি নজির কি বলে- ১৬ বছরের অধিক কোন বয়সী কোনো মেয়েকে যদি কোন পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে তাহলে তা ধর্ষণের আওতায় আসবে না।
হানিফ শেখ বনাম আছিয়া বেগম ৫১ ডিএলআর ১২৯ ধর্ষণ প্রমাণ করতে হলে ভুক্তভুগিকে প্রমাণ করতে হবে যে সে ধর্ষণ থেকে বাচার জন্য বাধা প্রধান করেছিল যেটা তার এজাহারে বা তার সাক্ষ্যে তুলে ধরতে হবে।
সোহেল রানা (মো:) বনাম রাষ্ট্র ৫৭ ডিএলআর ৫৯১ যদি কেউ সুযোগের সতব্যব্হার করে (বে আইনিভাবে না) কোন সাবালক মেয়ের সাথে তার সম্মতিতে তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তবে সেটা কোন আইনের আওতায় পরবে না।
কামাল হোছাইন বনাম রাষ্ট্র ৬১ ডিএলআর ৫০৫ উপরোক্ত নজীর আলোচনা করে আমরা সহজে অনুধাবন করতে পারি প্রলোভন দেখিয়ে সম্মতি নিয়ে ১৬ বছরের অধিক বয়সের মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে ধর্ষণ বলা যাবে না।
কোন প্রতিকার কি আছে?
যেহেতু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ প্রলোভন শব্দটি ব্যবহার করেনি কিন্ত প্রতারণামূলকভাবে শব্দটি ব্যবহার করলেও এটা বলতে কি বুঝাবে তা নিদির্ষ্ট করে ব্যাখ্যা করে নাই। সেহেতু এই দুইটি শব্দ ব্যবহার করে কোন মামলা হলে তাকে ধর্ষণ মামলা বলা যাবে না। কারণ আপনি যখন প্রলোভন শব্দ ব্যবহার করে মামলা করবেন তখন প্রশ্ন চলে আসবে কিসের প্রলোভন? উত্তরটা হবে বিয়ের প্রলোভন ।
তখন একটা অনৈতিক বা বে-আইনী বিষয় সামনে চলে আসবে,তা হলো “লোভ”। যেটা অনৈতিক বা বে-আইনী সেটার মাধ্যমে আইনী প্রতিকার আশাকরাটাও বোকামি। বড় জোর প্রাতারণার মামলা হতে পারে।যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে দন্ডবিধির ধারা ৪১৫তে, যে ব্যক্তি, কোন ব্যক্তিকে ফাঁকি দিয়ে প্রতারণামূলকভাবে বা অসাধুভাবে উক্ত ফাঁকি প্রদত্ত ব্যক্তিকে কোন ব্যক্তির নিকট কোন সম্পত্তি সমর্পন করতে বা কোন ব্যক্তির কোন সম্পত্তি সংরক্ষণের ব্যাপারে সম্মতি দান করতে প্ররোচিত করে, কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে অনুরূপ ফাঁকি প্রদত্ত ব্যক্তিকে এইরূপ কোন কার্য করতে বা উহা করা হতে বিরত থাকতে প্রবৃত্ত করে যে, সে কাজ অনুরূপভাবে ফাঁকি প্রদত্ত না হলে করতো না বা উহা করা হতে বিরত থাকতো না এবং যে কার্য বা বিরতি উত্ত ব্যক্তির দেহ, মন সুনাম বা সম্পত্তির ক্ষতি বা অনিষ্ট সাধন করে বা করবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেই ব্যক্তি ‘প্রতারণা’ করে বলে গণ্য হবে।
উদাহরন: সুমন (ছদ্মনাম) এবং আরিফা (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন ধরে একটা ফ্ল্যাটে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করে আসছে। দুইজনই প্রাপ্ত বয়স্ক। কিন্তু তাদের কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। তারা যেই ফ্ল্যাটে তাকে তার আশে-পাশের সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দা মোটা-মোটি জানে যে তারা স্বামী-স্ত্রী। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে কোন সমস্যার সৃস্টি হলে সুমন অস্বীকার করতে পারবে না আরিফা তার বউ নই।
কারণ আমাদের সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ ধারা ৫০ উল্লেখ করেছে, যেইক্ষেত্রে ত্রক ব্যক্তির সাথে অন্য কোন ব্যক্তির সম্পর্কের ব্যাপারে আদালতকে অভিমতে উপনীত হতে হয়, সেক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য হিসেবে বা অন্যভাবে এ ব্যাপারে যার জ্ঞানের বিশেষ উৎস আছে, উক্ত সম্পর্কের অস্তিতব সম্পর্কে তার আচরণের মধ্যে দিয়ে যে অভিমত ব্যক্ত হয়, তা প্রাসংগিক ঘটনা।
উক্ত ধারার রেফারেন্স টেনে ২০১১ সালের ৩১ জুলাই মমতাজ বেগম বনাম আনয়ার হোছেন মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতি এস কে সিনহা মন্তব্য করেছেন, মুসলিম নর ও নারী যদি স্বমী ও স্ত্রীর পরিচয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করেন এবং তাঁদের মধ্যে যদি রেজিস্ট্রিকৃত কাবিননামা না-ও হয়ে থাকে, তাহলেও এখানে বৈধ বিয়ের অস্থিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। তারা উভয়ে স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের মধ্যে মুসলিম আইন অনুযায়ী বৈধ বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বলেও গণ্য হতে পারে। সুতরাং কাবিননামা ছাড়া স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলে বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে।
উপরোক্ত বিষয়ের আলোকে আমরা বলতে পারি, বিয়ের প্রলোভন বা বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ বলে আইনে কিছুই নেই। তবে এই রকম ঘটনা কারো সাথে ঘটলে আইনের আশ্রয় নেওয়া যাবে যা আমি উপরে আলোচনা করেছি।
লেখক: এস.এম. আব্দুর রহমান সেলিম
আইনজীবী জেলা ও দায়রা জর্জ আদালত, চট্টগ্রাম।
Discussion about this post