বিশেষ প্রতিবেদক:
কক্সবাজারের রামু ট্র্যাজেডির ৯ বছর আজ। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে গুজবের সূত্র ধরে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ পল্লীতে এক যোগে অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনা ঘটিয়েছিল দুর্বৃত্তের দল।
পরের দিন একই ঘটনার জের ধরে উখিয়া ও টেকনাফের আরো ৭টি বৌদ্ধ বিহার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এ হামলার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যে ফাটল দেখা দেয় পুরো দেশ জুড়ে। পুড়ে যাওয়া ঐতিহ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে দ্রুত সময়ে সুরম্য অট্টালিকা ও নিরাপত্তা বলয়ে হারানো পূর্বের সম্প্রীতি ফিরেছে। মুছে গেছে ক্ষত চিহ্নও।
কিন্তু সাক্ষীর অভাবে শেষ হচ্ছে না মামলার বিচারিক কার্যক্রম। অনাকাঙ্খিত এ হামলার দিবসটি উপলক্ষে উপাসনালয়ে আজ বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। এমনটি জানিয়েছেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা।
করোনাকালীন সময়ে সাক্ষীদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ সম্ভব না হওয়ায় বিচার কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম।
এ ঘটনায় করা ১৯ মামলায় ১৫ হাজার ১৮২ আসামির কম-বেশি সবাই জামিনে রয়েছেন। ৫২৬ জন গ্রেফতার হওয়ার পর জামিন নেন আর বাকিরা আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন আদালত সূত্র।
তবে এখনও প্রায় শতাধিক অভিযুক্ত আসামী পলাতক রয়েছে। সব মামলারই চার্জশিট হলেও সাক্ষীর চরম সংকটে ঝুলে আছে বিচার কার্যক্রম। এমনটি দাবি পিপি ফরিদুল আলমের।
সূত্র জানায়, বৌদ্ধপল্লী ট্যাজেডি নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিটি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিলেও গত ৯ বছরে মামলার চূড়ান্ত শুনানির অগ্রগতি হয়নি।
ঘটনার হোতাদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল গঠন করা হলেও সাক্ষীর কারণে মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। ফলে এসব মামলার আইনি কার্যক্রম নিয়ে সংশয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে বিচারকার্য নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও সম্প্রীতিতে আস্থার সংকট অনেকটা কেটেছে।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ আল কোরআনের অবমাননাকর ছবি পোস্ট করাকে কেন্দ্র করে দুর্বৃত্তরা কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালিয়। ধ্বংস করে ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও ২৬টি বসতঘর। রামু থেকে এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে উখিয়া, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের পটিয়া পর্যন্ত।
এক শ্রেণির ধর্মান্ধরা বৌদ্ধপল্লী ও মন্দিরে উদ্দেশ্যমূলক হামলা চালায়। সেই সময় পুড়ে যায় রামুর বহু বছরের পুরনো এসব বৌদ্ধ বিহার। হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয় আরও ৭টি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘরে। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে উখিয়া ও টেকনাফে আরও চারটি বৌদ্ধবিহারে হামলা হয়। পুড়ে যায় বিহারে থাকা হাজার বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
এ ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়। এর মধ্যে রামু থানায় আটটি, উখিয়ায় সাতটি, টেকনাফে দুটি ও কক্সবাজার সদর থানায় দুটি মামলা রেকর্ড হয়। এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে।
কক্সবাজার আদালতের কোর্ট পরিদর্শক চন্দন চক্রবর্তী বলেন, ১৯টি মামলার মাঝে রামু থানায় সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দুই পক্ষের আপোস মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দেন আদালত। বাকি ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন এবং সবগুলো মামলাই সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে আছে।
তবে উপযুক্ত সাক্ষী না পাওয়ায় থমকে আছে মামলার গতি। নাম-ঠিকানা ধরে পাওয়া যাচ্ছে না মামলার বেশিরভাগ সাক্ষীকে। যাদের পাওয়া যায় তাদের অনেকে আবার আসামির পক্ষে কথা বলায় চিহ্নিত হচ্ছেন ‘বৈরি সাক্ষী’ হিসেবে।
কক্সবাজার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার সরওয়ার আলম বলেন, রামুর উখিয়ার ঘোনা জেতবন বৌদ্ধ বিহার, লট উখিয়ারঘোনা জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার ও ফতেখাঁরকুলের লালচিং, সাদাচিং ও মৈত্রী বিহার এবং চাকমারকুল ইউনিয়নের অজান্ত বৌদ্ধ বিহার এবং উখিয়ার একটি মামলা আদালত থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই’র কাছে পাঠানো হয়েছিল।
তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের শেষের দিকে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হয়। সাক্ষী পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে অনেককে শনাক্ত করে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ সূত্র জানায়, বৌদ্ধপল্লী ট্র্যাজেডির সব মামলার বাদীই পুলিশ। পুলিশ কাকে আসামি করেছে, কাকে বাদ দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্তরা কিছুই জানে না। যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন, ভাঙচুর- অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এদের অনেকের নাম অভিযোগপত্রে নেই।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান আইজীবী ঐক্য পরিষদ কক্সবাজার জেলা শাখার সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাপ্পী শর্মা বলেন, বৌদ্ধপল্লী ট্র্যাজেডির কারণে রামুর সহস্র বছরের গর্ব ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে’ যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল তা কেটেছে। আমাদের প্রত্যাশা প্রকৃত অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা হলে সম্প্রীতির জায়গাটা আরও সমৃদ্ধ হবে।
একই সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি দ্রুত সময়ে দৃষ্টি নন্দন মন্দির স্থাপন করে ক্ষত স্থান মুছে দেয়ার জন্য।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো: হাসানুজ্জামান বলেন, মোট ১৮টি মামলায় এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক আসামীকে পুলিশ গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনেছে। যেসব আসামি পলাতক রয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনার প্রচেষ্টা চলছে।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা নীতিশ বড়ুয়া বলেন, আমাদের শত-সহস্র বছরের ঐতিহ্য পুড়ে গেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা আমাদের অর্ধশত বছর এগিয়ে দিয়েছেন। আমরা পুরনো সময়ের মতো অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সব ধর্মের লোকজন একীভূত হয়ে চলতে চাই।
কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল বলেছেন, অনাকাংখিত এ ঘটনার পর পরই সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগকে দিয়ে পুড়ে যাওয়া বৌদ্ধমন্দিরগুলো অত্যাধুনিক সুরম্য অট্টালিকা হিসেবে গড়ে দিয়েছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা বর্তমানে পর্যটনের একটি অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। গড়ে দেয়া হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাড়িও।
Discussion about this post