সেলিম উদ্দীন, ঈদগাঁও:
কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁও’তে চলতি মাসের ১৯ মে কিশোরী খুকুমনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ধুম্রজাল দিন দিন ঘনিভূত হচ্ছে। খুকুমনির বাবা মায়ের দেয়া বক্তব্যকে সাজানো গল্প বলে দাবি করেছেন এলাকাবাসী।
গত কদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে অস্বাভাবিক এ মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও সংশ্লিষ্ঠ কতৃপক্ষের নির্লিপ্ততা নিয়ে জনমনে ব্যাপক প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।
নিহত খুকুমনির স্বজন, প্রতিবেশী, গ্রামবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য এবং ঘটনার বর্ণনা ভিন্ন ভিন্ন।
সরেজমিনে পরিদর্শণকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার লোকজন এটিকে ঠান্ডা মাথায় খুন বলে দাবী করেছেন।
তাদের দাবী ওই এলাকার একটি প্রভাবশালী চক্র ঈদগাঁও থানা পুলিশকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে পুরো ঘটনাটিকে নিছক দূর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে সক্ষম হয়।
পুলিশের ভাষায় এটি দূর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হলেও এ ব্যাপারে থানায় কোন ইউডি বা অপমৃত্যুর মামলাও রেকর্ড করেনি ঈদগাঁও থানা পুলিশ।
ঘটনার দিন কোন ধরনের অটোপসী কিংবা পোস্টমর্টেম না করে তড়িগড়ি করে লাশ দাফন জনমনে থানা পুলিশ সম্পর্কে সন্দেহজনক ও চরম নেতিবাচক ধারনা তৈরী হয়েছে।
অথচ আইন অনুযায়ী প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে যেকোন মৃত্যুই অস্বাভাবিক বা অপমৃত্যু।
উল্লেখ্য, গত ১৯ মে বুধবার ঈদগাঁও থানার অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়নের পশ্চিম ভাদিতলা গ্রামের রফিকুল ইসলাম (প্রকাশ বার্মাইয়া রফিক) ও জোবাইদা আক্তারের মেয়ে খুকুমনি (১৩) অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে।
নিহত খুকুমনির পিতা রফিকের দাবি দূর্ঘটনাবশতঃ সিলিংফ্যানের সাথে ওড়না পেচিয়ে যাওয়ায় ঘরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মাথায় আঘাতের ফলে তার মেয়ের মৃত্যু হয়।
স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে ঈদগাঁও থানা ওসি মুহাম্মদ আবদুল হালিমও খুকুমনির গলায় এবং মাথায় আঘাতের কথা স্বীকার করে ঘটনাটিকে নিছক একটি দূর্ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা দেন।
জানা গেছে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের একটি চক্র নানা তদবীর ও দেন-দরবারের মাধ্যমে পোস্টমর্টেম ছাড়া লাশ দাফনের চেষ্টা চালায় এবং সফল হয়ে তড়িঘড়ি করে লাশ দাফন সম্পন্ন করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসী জানায়, ওয়ার্ড মেম্বার জিয়াউল হকই পুলিশের সাথে দফা রফার কাজটি সম্পন্ন করেন।
এ ব্যাপারে জানতে মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেয়ো হলেও ফোন বন্ধ থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এদিকে ইতোমধ্যেই পুরো এলাকায় ওই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা লোকমুখে চাউর হয়েছে। যা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের সাথে মিলে যায়।
একপক্ষের দাবি খুকুমনি আত্মহত্যা করেছে, অপর পক্ষের দাবি কিশোরী খুকুমনির প্রেমঘটিত বিষয়ে প্রচণ্ডভাবে ক্ষুদ্ধ পিতা রফিক বেধড়কভাবে পিটিয়ে কন্যা খুকুমনিকে হত্যা করে। পরে ঘরের সিলিংফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দুর্ঘটনার নাটক সাজায়।
স্থানীয়দের মতে, প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গা নাগরিক রফিক দীর্ঘদিন ধরে তার বসতবাড়ীর পাশে একটি মুদির দোকান করে আসছে। দোকান থেকে তার ঘরের দুরত্ব মাত্র ১৫-২০ ফুট।
অসমর্থিত একটি সূত্র মতে, স্থানীয় সোহেল নামের এক যুবকের সাথে খুকুমনি মন দেয়ানেয়া চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। মাঝে মাঝে লোকচক্ষুর আড়ালে এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকা প্রেম অভিসারে মিলিত হত।
ঘটনার দিন ফাঁকা ঘরে (মা ও পরিবারের সদস্যদের অনুপস্থিতির সুবাদে) খুকুমনি তার প্রেমিক সোহেলকে নিজ বাসায় ডেকে আনে (খুকুমনির) মা জোবায়রা আক্তার নিজেও ওইদিন ঘরে না থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
একপর্যায়ে পিতা রফিক জরুরী প্রয়োজনে ঘরে প্রবেশ করলে আপত্তিকর অবস্থায় খুকুমনি ও সোহেল দু’জনকে দেখে ফেলে। প্রেমিক সোহেল খুকুমনির পিতার উপস্থিতি বুঝতে পেরে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়।
রফিকও সোহেলকে ধরার জন্য তার পেছন পেছন অনেক দুর পর্যন্ত দৌঁড়াতে থাকে। সোহেলকে ধরতে না পেরে খুকুমনির পিতা রফিক ক্ষোভে ফুসঁতে উঠে এবং নিজ ঘরে ফিরে এসে বিক্ষুদ্ধ রফিক সমস্ত রাগ ও শক্তি দিয়ে তার কিশোরী কন্যা খুকুমনিকে বেধড়ক পিটানো শুরু করে। শক্ত কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই খুকুমনির মৃত্যু হয়।
সম্বিত ফিরে আসলে রফিক খুকুমনির গলায় ওড়না পেচিয়ে ফ্যানে ঝুলিয়ে দেয় এবং ঈদগাঁও থানা পুলিশকে খবর দেয়।
এরপর রফিক তার প্রভাবশালী আত্মীয় স্বজনকে ব্যবহার করে পুলিশকে ম্যানেজ করে লক্ষে পৌঁছে যেতে সক্ষম হন।
জনমনে প্রশ্ন? আইনের পথে না হেঁটে পুলিশ কেন এমন করল? এটি কি ঈদগাঁও থানা পুলিশের অদক্ষতা? অনভিজ্ঞতা? নাকি বৈষয়িক বা ব্যক্তিতান্ত্রিক প্রভাব?
তথ্যমতে, গত ২০ জানুয়ারি নবগঠিত ঈদগাঁও থানার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করার পর থেকে সংঘটিত একের পর এক হত্যাকাণ্ড ও অপরাধমূলক ঘটনা সাধারণ মানুষের মনে থানা পুলিশ সম্পর্কে একপ্রকার নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে।
বিভিন্নস্থানে অপরাধ দমন ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ঈদগাঁও থানা পুলিশের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, দায়বদ্ধতা নিয়ে বহুমাত্রিক আলোচনা সমালোচনার শেষ নেই।
এলাকাবাসীর দাবী কিশোরী খুকুমনির অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাটি হত্যাকাণ্ড নাকি দূর্ঘটনা সেই রহস্য বা প্রকৃত কারণ উন্মোচন করা পুলিশের দায়িত্ব।
ঈদগাঁও পুলিশের উদাসীনতা, শৈথিল্যতা কিংবা মোহগ্রস্ততা কিংবা অবহেলার কারণে কোন অপরাধ সংঘটিত হয় কিংবা চিহ্নিত কোন অপরাধী সংঘটিত অপরাধ থেকে দায়মুক্ত হয় তবে তার জন্য অপরাধী কে? রাষ্ট্র? নাগরিক? নাকি সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ এ প্রশ্ন আজ ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মামুন আল ইসলাম এবিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
Discussion about this post