ইয়াস-নামের একটি ঘূর্ণিঝড় কাল-পরশু উপকূলে আঘাত হানছে,খবরটি সবার জানা। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির তেমন আশঙ্কা না থাকলেও ঝোড়ো হাওয়া-ভারীবর্ষণ তো হতেই পারে।
ইতিমধ্যে উপকূলের কিছু কিছু এলাকায় বজ্রপাতসহ থেমে থেমে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। আর তাতেই আতঙ্ক লবণ চাষীদের। কারণ বৃষ্টি হলে মাঠে উৎপাদিত লবণ নিমিশেই গলে যাবে, পানি দিয়ে তৈরি লবণ পানিতে মিশে যাবে।
চাষীদের আতঙ্কের খবর দেখতে ছুটে গিয়েছিলাম সুদুর টেকনাফ সীমান্তের হ্নীলা, খারাংখালী, রঙিখালী, লেদা এলাকায়। অবাক কান্ড। প্রচন্ড তাপদাহে নাফনদীর তীরের হাজার হাজার একর জমিতে উৎপাদিত হচ্ছে লবণ। খোলা মাঠে স্তুপ আকারে পড়ে আছে লাখ লাখ টন লবণ।
দূরের লবণগুলো চাষীরা কাছাকাছিতে নিয়ে আসছেন। তবে বেচাবিক্রি নেই। প্রতিমণ লবণ উৎপাদন করতে চাষীদের খরচ যায় ২৩০ টাকা, অথচ বিক্রি করতে হচ্ছে ১২০ টাকায়। প্রতিমণে লোকসান ১১০ টাকা।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের লবণমিল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছে। এখন সেই লবণও যদি ঘূর্ণিঝড় কিংবা বৃষ্টিতে ভিঁজে নষ্ট হয়-তাহলে চাষীদের কী অবস্থা হবে ভেবে দেখেছেন? করোনাকালের বিপদ তো আছেই।
এমনিতে লবণ চাষীরা কয়েক বছর ধরে উৎপাদিত লবণের নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। বিদেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে আমদানি করা সোডিয়াম সালফেট মিশ্রিত লবণ ভোজ্য হিসাবে বাজারজাত করায় বাজারদর হারিয়েছে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চাষীদের লবণ। সোডিয়াম সালফেট আমদানি নিষিদ্ধ অথবা সীমিতকরণের জন্য চাষীরা কত আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, পত্রপত্রিকায় কত লেখালেখি হল, কাজ কিছুই হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে জেলার টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া ও কুতুবদিয়া উপজেলার ৫৪ হাজার ৬৫৪ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিকটন। এরমধ্যে অবিক্রিত অবস্থায় মাঠে পড়ে আছে সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিকটন লবণ।
খোলামাঠে পড়ে থাকা লবণগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নাই। বৃষ্টিপাত হলে লবণ নষ্ট হবে, এই আতঙ্কে চাষীরা দিশেহারা। তারা নানাভাবে লবণগুলো রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
চাষীরা ছোট যানবাহনে বোঝাই করে মাঠের লবণ নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির উঠানে। তারপর সেই লবণের ওপরে পলিথিন মোড়িয়ে ইট চাপা দিচ্ছেন। যেন বাতাস পলিথিন উড়িয়ে নিতে না পারে। কেউ কেউ মাঠে বড় গর্ত খুঁড়ে তাতে লবণ পুঁতে ওপর থেকে মাটি চাপা দিচ্ছেন। তাতেও চাষীদের খরচ হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।
এক চাষীর দুঃখের কাহিনী শুনে অবাক হলাম। চলতি মাসের ২০ তারিখ তাঁর মেয়ের বিয়ের দিন ছিল। লবণ বিক্রি হয়নি, তাই টাকার সংকট। শেষমেষ বিয়েটা ভেঙে গেল।
অধিকাংশ চাষী দাদনের টাকায় মাঠে নামেন লবণ চাষে। লোকসান দিয়েও লবণ বিক্রি হচ্ছে না, দাদনের টাকা পরিশোধ করবেন কোত্থেকে? এজন্যও বহু চাষী হয়রানীর শিকার হচ্ছেন, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে।
এমনিভাবে একসময়ের সোদাসোনা খ্যাত ‘লবণ’ উপকূলের প্রতিটা পরিবারে সৃষ্টি করছে টানাপোড়েন, অশান্তি। কত দিন চলবে-এই সংকট?
লেখক: আব্দুল কুদ্দুস রানা
বিশেষ প্রতিবেদক ও অফিস প্রধান, কক্সবাজার। দৈনিক প্রথম আলো।
Discussion about this post